পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
কী লেখা থাকে সেইসব চিঠিতে? লেখা থাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অথবা অর্থমন্ত্রী আর যাই করুন কৃষকদের সাহায্য করার নামে প্রতি বছর অথবা বছরের মাঝখানে ব্যাঙ্ক আরও বেশি বেশি ঋণ দেবে এই ঘোষণা করবেন না। কারণ কী? ব্যাঙ্ক ঋণ দিলে তো সুবিধাই হয়! অবশ্যই হয়। কিন্তু তখনই উপকার হবে যখন সেই ঋণ পাওয়া যাবে। এইসব কৃষকের আত্মহত্যার নোটে লেখা থাকে স্যার, আমাদের মতো ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষকদের কখনওই ব্যাঙ্ক সেই ঋণ দেয় না। সিংহভাগ ঋণ চলে যায় বড় চাষিদের কাছে। সোজা কথায় বোঝা গেল স্মল ল্যান্ড হোল্ডিং কাছে এরকম চাষিরা ব্যাঙ্ক ঋণের সুবিধা পায়নি। তাদের যথারীতি তাই মহাজনদের থেকে উচ্চ সুদের হারে ঋণ নিতে হয়েছে। এবং ঋণ ফেরত দিতে না পেরে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। শুধু মহারাষ্ট্রের কথা ধরা যাক। মহারাষ্ট্রে ২০১৭ সালে কৃষিঋণ সবথেকে বেশি কোন দুটি শহর থেকে ইস্যু করা হয়েছিল? ভারতের অন্যতম ধনী দুটি শহর। মুম্বই ও পুণে। রাজ্যের ৫৩ শতাংশ কৃষিঋণ ইস্যু হয়েছে এই দুটি চূড়ান্ত আধুনিক শহরের মেট্রো ব্রাঞ্চ ব্যাঙ্কগুলি থেকে। দেশের সবথেকে বেশি পাসপোর্ট ইস্যু হয় এই দুই শহর থেকে। আর দেশের সবথেকে বেশি কৃষিঋণ ইস্যু হয়েছে এই দুই শহর থেকে। যাই হোক। কৃষকদের ওই আত্মহত্যার নোটের মাধ্যমে তাদের সেই ক্রমাগত আকুতি সরকারপক্ষ থেকে সেভাবে আমল না দেওয়ায় মৃত্যুর আগে পিছনে রেখে যাওয়া কৃষক সমাজের কথা ভেবে মরিয়া প্ল্যান করে আত্মহত্যা করেছেন মহারাষ্ট্রের রামচন্দ্রন রতন রাউত। তিনি ৫০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে দুঃখের কাহিনী লিখেছেন দেশের অর্থমন্ত্রীকে সম্বোধন করে।
কেন? কারণ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা হল যে কোনও লেনদেন কিংবা চুক্তিকে সিরিয়াসলি নেওয়া হয় যদি সেটি স্ট্যাম্প পেপারে স্বাক্ষর করা থাকে। রামচন্দ্রন রতন রাউথ তাই আত্মহত্যা করার আগে নিকটবর্তী গঞ্জে গিয়ে কিনেছিলেন স্ট্যাম্পপেপার। এবং সেটিতে আগেভাগেই নোটারি দিয়ে স্ট্যাম্প মেরে রেখেছেন। তারপর বাড়ি ফিরে ধীরেসুস্থে আত্মহত্যার নোট লিখে কীটনাশক খেয়েছেন। যাতে সরকার অন্তত তাঁকে সিরিয়াসলি নেয়। একদিকে তিনি ঋণও পাননি সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে। আবার অন্যদিকে সস্তার চাল গমও পান না। কারণ তাঁর কাছে বিপিএল কার্ড নেই। তিনি কৃষক, কিন্তু বিপিএল নয়। কারণ তিনি গরিব কিনা সেটার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ হয়নি এতকাল। ভারতের প্রতিটি সরকার গরিব খোঁজার চেষ্টা করে। স্বাধীনতার পর ৭০ বছর ধরে সবথেকে কঠিন যে অঙ্ক প্রতিটি সরকার কষে চলেছে সেটি হল গরিবের সংজ্ঞা কী? কাকে বলে গরিব? এটাই জানা যাচ্ছে না।
সেই ১৯৭৪ সালে স্থির হয়েছিল প্রতিদিন ২৪০০ ক্যালরির কম খাবার যেসব মানুষ খায় গ্রামে তাদেরই বলা হবে গরিব। শহরে সেটাই ২১০০ ক্যালরি। ২০০০ সালে সেটা পাল্টে গেল। তখন বলা হল যে ব্যক্তি গ্রামে মাসে ৩২৮ টাকার কম আয় করে সে হল গরিব। আর শহরের ক্ষেত্রে সেটি হবে ৪৫৪ টাকা। ২০০৫ সালের পর আবার নতুন হিসেব। গ্রামীণ এলাকায় দিনে ২২ টাকার কম খরচ করে যারা তারাই সরকারের চোখে গরিব। ২০০৫ সালে বলা হয়েছিল ভারতের গরিবের সংখ্যা ৩৭ শতাংশ। ২০০৯ সালেই সেটা হয়ে গেল ২৯ শতাংশ। অবশ্য এইসব ম্যাজিক নতুন নয়। ১৯৯৫ সালে সবথেকে মজার ঘটনা ঘটে। সেবার কোপেনহেগেনে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল দেশে গরিবের সংখ্যা ৪০ শতাংশ। আর ঠিক নির্বাচনের আগে সরকার হিসেব করে দেখিয়েছিল কীভাবে বিগত পাঁচ বছরের উন্নতির জন্য হঠাৎ করেই গরিবের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ২০ শতাংশ! সেই নির্বাচনে সরকারি দল কংগ্রেস হেরে যায়। যে সরকার আসে সেই যুক্তফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী মধু দণ্ডবতে ক্ষমতায় এসেই আবার গরিবের সংখ্যা চাইলেন আধিকারিকদের কাছে। তাঁকে দেওয়া হল নতুন হিসেব। তখন গরিব বেড়ে গেল। ৪১ শতাংশ। ২০০৬ সালে সুরে তেন্ডুলকর কমিটি নিয়োগ করা হল গরিবের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে। সেই কমিটি রিপোর্ট দিল গরিবের পরিমাণ ৩৭ শতাংশ। আবার এন সি সাকসেনা কমিটি বলল, না না ওসব অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছে। আসল সংখ্যাটা হল ৫০ শতাংশ। তবে সবথেকে বড় বোমাটি ফাটালেন অর্জুন সেনগুপ্ত। তাঁর নেতৃত্বধীন কমিটি রীতিমতো সার্ভে করে জানিয়ে দিল ভারতের ৭৭ শতাংশ জনগণই দিনে ২০ টাকার কম আয় করে। অর্থাৎ ৭৭ শতাংশই গরিব!
নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ! তিনি গরিবের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন। এই প্রথম অবশেষে গরিব মানুষ নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারলেন। একটা ডেফিনিশন পেলেন নিজেদের জন্য। গরিবদের জন্য সাংঘাতিক একটা উপকার করেছেন। গরিবদের আজীবনের একটাই স্বপ্ন থাকে। বড়লোক হওয়া। সেটা তো আর সম্ভব হয় না। তাহলে বড়লোকদের সঙ্গে একাসনে বসার উপায় কী? এতদিন এরকম কিছুই ছিল না। ধনী দরিদ্র ফারাক থাকবেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এমন একটা ম্যাজিক করলেন, যে গরিব মানুষ এতকাল যাঁদের বড়লোক ভেবে এসেছেন, মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সেই লোকগুলো নিমেষে গরিব হয়ে গেল। এর থেকে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে গরিবের কাছে? কোনও কমিটি ফমিটি নিয়োগ নয়। কোনও রিপোর্ট আসার অপেক্ষা নয়। সোজাসুজি ঘোষণা।
এবার থেকে মাসে ৬৬ হাজার টাকার কম আয় হলেই সেই পরিবার গরিব। তার মানে কী? উচ্চবর্ণের জন্য সরকারি চাকরি আর উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ পাবে শুধু এই গরিবরা। এই শর্তের আওতায় চলে আসবে অন্তত ১২৫ কোটি মানুষই। আরও আনন্দদায়ক বার্তাটি কী? সেটি হল উচ্চবর্ণের যে মানুষটি মাসে ৮ হাজার টাকা আয় করেন তিনিও গরিব। আর যিনি মাসে ৬৫ হাজার টাকা আয় করেন তিনিও গরিব। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলার রাজমহল খনির পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির সিংহভাগের নাম হল কোয়লাওয়ালা। এরা ২৫০ কেজি ফেলে দেওয়া বর্জ্য থেকে বাছাই করা কয়লার টুকরো সাইকেলে চাপিয়ে সপ্তাহে চারদিন ৩০ কিলোমিটার হেঁটে কাছের বাজারে যায় সেই কয়লা বিক্রি করতে। কত টাকার জন্য? ৯০ টাকা! ভারতের ৯০ কোটির বেশি মানুষ মাসে ১০ হাজার টাকার কম আয় করে। ভারতের ৪০ কোটি মানুষ কোনওদিন কোনও স্কুলের মুখ দেখেনি। গরিবদের সুবিধা করে দেওয়ার লক্ষ্যে ৬৬ হাজার টাকা আয়ের মানুষদের জন্য সরকারি চাকরি আর উচ্চশিক্ষার সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে।
এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গরিব উচ্চবর্ণের গরিবদের চাকরি পাওয়া আরও সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু ওই আয়ের শর্তটি সেই সুযোগ কতটা ছিনিয়ে নিতে চলেছে? যে পরিবারের আয় মাসে ৬৬ হাজার টাকা তারা কিন্তু নিজেদের সন্তানকে ফিটজি অথবা আকাশের মতো কোনও প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর খরচ বহন করতে পারবে। তারা সন্তানদের পাঠাতে পারবে প্রাইভেট টিউশনে। কিন্তু যে পরিবারের আয় মাসে ১২ হাজার টাকা, তারা কি এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে? সেক্ষেত্রে শেষ বিচারে তাদের কাছে সংরক্ষণ কোনও কাজে আসবে না। তাদের জন্য রয়ে যাবে সেই একটাই জিনিস। এক ও একমাত্র মেধা। অথচ দুটি পরিবারই ১০ শতাংশ সংরক্ষণ পাবে। একটি পরিবার মেধা প্লাস সংরক্ষণ। আর অন্য পরিবার মেধা প্লাস সংরক্ষণ প্লাস এক্সট্রা টিউশনের সুযোগ। তাহলে কে এগিয়ে থাকবে?
কৃষক আত্মহত্যার কাহিনী দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু হয়েছিল। তাঁদের সম্পর্কে একটি অঙ্ক দিয়েই বরং শেষ করা যাক। নতুন আইনে বলা হয়েছে যাদের মাসে আয় ৬৬ হাজার টাকা তারা গরিব। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অনুযায়ী পরিবারে ৫ জন সদস্য ধরে দিয়ে ভারতের কৃষক পরিবারের গড় আয় কত? ৬৪২৬ টাকা!