বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
‘জিন এডিটিং’-এর উদ্ভাবক ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের তন্বী-সুন্দরী জীব-রসায়নবিদ জেনিফার ডুনডা। দু বছর আগে, সতীর্থ ইমানুয়েল শঁপাটির সঙ্গে বার্লিনের ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইউনিট ফর দি সায়েন্স অফ প্যাথোজেনে’ জেনিফার CRISPR-Cas9 (ক্লাসটার্ড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালিনড্রোম রিপিটস-ক্রিসপার অ্যাসোসিয়েটেড প্রোটিন নাইন) পদ্ধতিটি আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বকে চমকে দেন। কোনও ভাইরাস যখন ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবকে আক্রমণ করে তখন আক্রান্ত ব্যাকটেরিয়ার ‘ক্রিসপার’ ঠিক তার নিউক্লিয়য়েজ উৎসেচক ‘ক্যাসকে’ ধারালো ছুরির মত ব্যবহার করে ভাইরাসের ডিএনএকে ফালাফালা করে দেয়। ভাইরাসের প্রাণভোমরা তার ডিএনএ, প্রাণভোমরার মৃত্যু মানে ভাইরাসের মৃত্যু। ভাইরাসের ডিএনএর কাটা টুকরোটা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর সঙ্গে লেপটে থেকে ‘জেনেটিক মেমরি’ ফর্মেশন করে। ভবিষ্যতে কোনওদিন ওই ভাইরাসটি আর ব্যাকটেরিয়াটিকে পেড়ে ফেলতে পারবে না। কারণ ‘মেমরির’ কল্যাণে ব্যাকটেরিয়া সচেতন, সে জানে কোন পথে সিঁধ কাটবে ভাইরাসটি। ‘ক্রিসপার’ আণবিক কাঁচি বা মলিকিউলার সিজর ‘ক্যাসকে’ গাইড আরএনএ বা gRNA মারফৎ একবারে জিপিএসের ঢঙে অপরিসীম সূক্ষ্মতায় ভাইরাসের ডিএনএর ঘাড়ে নিয়ে ফেলে। ‘ক্যাস’ ঠান্ডা মাথায় হাসতে হাসতে হাসতে ভাইরাল ডিএনএকে জবাই করে। পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে ভাইরাসটির। জিআরএনএ-র কাঁকড়ার মত স্পষ্ট দুটো দাঁড়া—লক্ষ্যবস্তুকে আঁকড়ে ধরে। ফলে কোনও অবস্থাতেই নিস্তার নেই ভাইরাসের। ক্যাস অনেকটা ‘সুইস নাইফে’র মত, ‘জিন এডিটিং’-এ স্রেফ সুইস নাইফের একমুখী কার্যকারিতাকে বহুমুখী করা হচ্ছে। ক্রিসপার-ক্যাস তখন অপ্রতিরোধ্য ক্রুজ মিসাইল। প্রকৃতির কী আশ্চর্য নৈপুণ্য! মানুষ অভ্রংলিহ বুদ্ধিমত্তায় প্রকৃতির সেই নৈপুণ্যকেই হাতিয়ার করছে।
অভূতপূর্ব সূক্ষ্মতায় জিনের কাটাছেঁড়া করা যায় এই ক্রিসপার-ক্যাস ‘জিন এডিটিং’-এ। রোগজরামুক্ত হতেই পারে গোটা প্রাণী বা উদ্ভিদকুল। সৃষ্টি করা যায় পছন্দসই প্রজাতি, ফিরিয়ে আনা সম্ভব বিলুপ্ত প্রজাতিদেরও। এতদিন যা ছিল ঈশ্বরের একচেটিয়া, বিজ্ঞানীরা তাতেই ভাগ বসাচ্ছেন, স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠছেন। সেখানেই সংশয়, আপত্তি, মূলত খ্রিস্টান (বা অন্য) ধর্মযাজকদের, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু—সবটাই ঈশ্বর নির্ধারিত। জার্মলাইন এডিটিং অর্থাৎ শুক্রাণু-ডিম্বাণু-ভ্রূণ-স্টেম সেল রিসার্চ তাদের মতে খোদার ওপর খোদকারি। সুতরাং আমেরিকা সহ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী দেশে ‘জিন এডিটিং’ নিষিদ্ধ। কিন্তু যে মুহূর্তে জেনিফারের গবেষণার খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল ধর্মগুরুদের রক্তচক্ষুর রোষানলে তাঁর রক্তচাপও বাড়তে লাগল। শঙ্কিত বিশ্ব: মানুষের জিনের চরিত্র পাল্টে গেলে মানুষ কি আর মানুষ থাকবে? জেনিফার এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন, তাঁরই এক সতীর্থ তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন, “জেনিফার, তুমি কি ‘ক্রিসপার-ক্যাস টেকনিকটা’ শেখাবে? একজন শিখতে চাইছে”। বন্ধুর সঙ্গে জেনিফার বিরাট এক হলঘরে ঢুকছেন, শেখানোর পালা শুরু হবে। হলঘরে ঢোকামাত্র জেনিফার চমকে উঠলেন, চেয়ারে শুয়োরের মুখোশ পরে বসে আছেন স্বয়ং হিটলার, তাঁকে অভিবাদন জানাবেন বলে। সেমুহূর্ত থেকে তাঁর রাতের ঘুম উড়ে গেল। জীববিজ্ঞানের অদ্যাবধি অবগুণ্ঠিত অমিত সম্ভাবনাময় বিভিন্ন অর্গল-বদ্ধ দরজা সপাটে উন্মোচনের দিশারি ‘জিন এডিটিং’, সেই অত্যুৎকৃষ্ট পদ্ধতিটি নানারকম বিতর্কের চোরাবালিতে শেষপর্যন্ত কি পথ হারাবে? প্রশ্ন উঠবে অর্বাচীন অনৈতিকতার? আশঙ্কিত জেনিফার শুরু করলেন ‘টেড টক’ (টেকনোলজি-এন্টারটেইনমেন্ট-ডিজাইন)। ২০১৫তে ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় খুঁটিনাটি অনুষঙ্গে ‘জিন এডিটিং-র’ অভাবনীয় সম্ভাবনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেন। ২০১৭তে তাঁরই ছাত্র স্যামুয়েল স্টার্নবার্গের সঙ্গে লিখলেন সাড়াজাগানো বই “এ ক্র্যাক ইন ক্রিয়েশন: জিন এডিটিং অ্যান্ড দি আনথিঙ্কেবল পাওয়ার টু কনট্রোল ইভোলিউশন”। ক্রিসপার-ক্যাস যুগলবন্দি কী অসাধ্যসাধন করতে পারে তার কয়েক ঝলক প্রাঞ্জলভাবে বর্ণনা করলেন। যেমন গোরু-ছাগল-ভেড়া-মুরগির মাংস ‘জিন এডিটিং’-এর দৌলতে হবে আরও স্বাস্থ্যকর-সুস্বাদু, থাকবে না কোনওরকম সংক্রমণের ভয়, ডিম-দুধ-বেগুন হবে অ্যালার্জি-রহিত, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন ফুরোবে। মশাদের ‘জিন এডিটিং’ করে ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি-এনসেফেলাইটিস প্রতিরোধ করা যাবে। ইঁদুর বহন করবে না প্লেগ বা লাইম ডিজিজ। শুয়োরের ‘জিন এডিটিং’-এর ফলে তাদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কিডনি-হার্ট-লাঙস মানুষের দেহে সরাসরি প্রতিস্থাপন করা যাবে। সম্ভাবনা থাকবে না শরীরের প্রত্যাখ্যানের। মানবশরীরে কেবল একটা জিনের মিউটেশনের ফলে হতে পারে সিষ্টিখ ফাইব্রোসিস, হান্টিংটন ডিজিজ বা সিকল সেল অ্যানিমিয়া। প্রাপ্তবয়সে ‘সোমাটিক জিন এডিটিং’ দ্বারা কোষের ভেতরের জিনের গড়বড়কে শুধরে দেওয়া যায়। এডিটিংয়ের পরে রোগমুক্তি ঘটবে চিরতরে। এডিটিংয়ের সুফল বা কুফল, কোনওটাই পরবর্তী প্রজন্মে বাহিত হবে না। কিন্তু অ্যালঝাইমার্স, ডায়াবেটিস বা কিছু ক্যান্সারের বীজকে শুক্রাণু/ডিম্বাণু/সদ্য-সৃষ্ট ভ্রূণেই বিনষ্ট করা প্রয়োজন, যাতে আগামীর শিশুটির কোনও সম্ভাবনাই না-থাকে ভবিষ্যতে অ্যালঝাইমার্স-ডায়াবেটিস/ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার। এক্ষেত্রে জিন এডিটিংয়ের সুফল পরবর্তী প্রজন্মে অবশ্যই বাহিত হবে। এটিতে শিশুর হাড়ের ঘনত্ব যেমন বাড়ানো যাবে (খেলোয়াড়দের আবশ্যিক) তেমনি বাড়ানো সম্ভব শারীরিক সক্ষমতা, সম্ভব নীল বা সোনালি চুলের মর্জিমাফিক ‘ডিজাইনার বেবি’ সৃষ্টিও।
সত্যিই কি সম্ভব ‘ডিজাইনার বেবি’ সৃষ্টি? ইমরি ইউনিভার্সিটির ‘রলিন্স স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’র ট্রান্সলেশনাল এপিডেমোলজির অধ্যাপিকা সেসেইল ইয়ানসেন বলছেন ‘জিন এডিটিং’-এ কখনওই মর্জিমাফিফ সন্তানলাভ সম্ভব নয়। বুদ্ধিমত্তা-স্বভাব-আচরণ-গানের গলা-কর্মদক্ষতার মত বিশেষ চরিত্রলক্ষণ বা ‘জেনেটিক ট্রেটস’ কখনওই ‘জিন এডিটিং’ দ্বারা সম্ভব নয়। সন্তান বাবা-মা-র গুণাবলি নিয়েই জন্মাবে। আইনস্টাইনের মত প্রখর বুদ্ধিমত্তা শুধু ‘জিন এডিটিং’-এ সম্ভব নয়, পরিবেশও সমানভাবে দায়ী সেই ব্যতিক্রমী বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ও বিচ্ছুরণে। জিন ও পরিবেশ হাতে হাত মিলিয়ে চললে তবেই সম্ভব শচীন/মাইকেল জ্যাকসনের অপার্থিব সৃষ্টি। বিটা-থ্যালাসেমিয়া/সিকল সেল অ্যানিমিয়া/ড্যুসেন মাসকুলার ডিসট্রফির কারণ একটা জিনের মিউটেশন। ‘জিন এডিটিং’-এ খুব সহজে তার নিরাময় সম্ভব। ‘জিন এডিটিং’ তখনই সম্ভব যখন বাবা-মার সূত্রে রোগটির ১০০% আত্মপ্রকাশ ঘটছে অপত্যে। গত ৫০ বছরের ‘উত্তরাধিকারের ইতিহাস’ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে মাত্র গুটিকয় জিনঘটিত রোগের বিস্তারের হার বাবা-মার থেকে সন্তানসন্ততিতে ৯০ শতাংশের বেশি। সেই সব ক্ষেত্রেই ভ্রূণাবস্থায় ‘জিন এডিটিং’ সফল হতেই পারে। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা-প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ক্ষেত্রে এই হার ৫০%, পেশিশক্তির ক্ষেত্রে ৭০%, ব্যক্তিত্ব-স্বভাব-গানের গলা-কর্মদক্ষতা-আচরণের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৪৫%। সুতরাং সর্বাধুনিক ক্রিসপার-ক্যাস পদ্ধতিতেও সম্ভব নয় কাঙ্ক্ষিত সন্তান লাভ। শেষ হাসিটা হাসবে প্রকৃতিই। একটা বিকল জিনের সফল সম্পাদনা নিশ্চয় সম্ভব; অধিকাংশ আধুনিক রোগ কিন্তু একটা জিনে সম্পৃক্ত নয়। অনেকগুলো জিন দায়ী বর্তমানের বেশিরভাগ ‘লাইফস্টাইল ডিজিসের’ মূলে। সেক্ষেত্রে ‘জিন এডিটিং’-এর ভূমিকা নীরব দর্শকের। জিন নয়, বিরল প্রতিভাধর হতে গেলে প্রয়োজন তাই শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবন-চর্যা ও পরিবেশের রগড়ানি, যা একেবারেই জিনবহির্ভূত।