উচ্চবিদ্যায় ভালো ফল হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে সুযোগ আসবে। কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। ব্যবসায় যুক্ত ... বিশদ
অবশ্য, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, তৃণমূলে যাবতীয় আলোর উৎস একটাই—মমতা, জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আকাশের সূর্যের মতো তাঁর আলোতেই আলোকিত ছোট বড় মাঝারি—বাকি সব মুখ। তো কোনও মুখের ওপর থেকে কোনও কারণে তাঁর আলো সরে গেলে সেই মুখটা যে অন্ধকারে ডুবে যাবে তাতে আশ্চর্য কী? আর অন্ধকারের আড়ালে বেশিদিন থাকলে মানুষের মনেও সে মুখের ছবিটা ঝাপসা হবে। হবেই। কারণ, মানুষ স্বভাবগতভাবে ভুলো। ভালো-মন্দ প্রিয়-অপ্রিয় দুঃখ-শোক উপকার—কোনও কিছুই বেশিদিন মনে রাখে না, রাখতে পারে না। আজকের এই চরম ব্যস্ততার দিনে তো কথাই নেই—সকালের কথা রাত অব্দি মনে রাখতেই হিমশিম মানুষ!
এমন পরিস্থিতিতেই আপাতত মমতার সঙ্গ ছাড়লেন মন্ত্রী ও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। কেন ছাড়লেন সে বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। সেটা একান্তভাবেই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এবং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গও যে তিনি চিরকালের মতো ত্যাগ করলেন এমন চূড়ান্ত কথাও বলছি না। রাজনীতির ক্ষেত্রে তেমনটা বলা মনে হয় না খুব বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, রাজনীতিতে অসম্ভব বা শেষ বলে কিছু নেই। কিন্তু, এই মুহূর্তে মিডিয়ায় সংবাদপত্রে ঘটনা পরম্পরা দেখেশুনে পড়ে রাজ্যবাসী এটুকু বুঝেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুদীর্ঘকালের সুখদুঃখের সঙ্গী, অন্যতম আস্থাভাজন লড়াকু নেতা, ‘মমতা দিদি’র স্নেহাস্পদ কাননের সঙ্গে আপাতত দল ও দলনেত্রীর একটা গুরুতর বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতার নির্দেশে মন্ত্রী এবং মেয়র পদ থেকে ইতিমধ্যেই ইস্তফা দিয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। নিজে থেকে বিধায়ক সমেত অন্য পদও ছাড়তে চেয়েছেন। এই বিচ্ছেদের ঘটনার সঙ্গেই উঠে এসেছে তাঁর কিছু অপ্রীতিকর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। মিডিয়া কাগজ মারফত সেসব খবরও আজ রাজ্যে কারও অজানা নয়।
অবশ্য, এই বিচ্ছেদ রাতারাতি ঘটেনি। অনেকদিন ধরেই এই বিচ্ছেদের পটভূমি তৈরি হচ্ছিল। বিচ্ছেদ ঠেকাতে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা অনেক চেষ্টাও করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার শোভনবাবুকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর দায়দায়িত্ব এবং দলীয় শৃঙ্খলার কথা স্মরণ করিয়ে প্রিয় ‘কানন’কে আজকের এই চূড়ান্ত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা চালিয়েছেন। তথ্যভিজ্ঞমহল সূত্রে খবর তেমনই। কিন্তু, ভবি তাতেও ভোলেনি। শোভনবাবু তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছেন। শেষপর্যন্ত, উপায়ন্ত না দেখে বেদনাদায়ক সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছে দলনেত্রী মমতাকে। ভোটের মুখে দলের ভাবমূর্তি এবং দলীয় শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব দিতে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন তিনি। এবং কলকাতার পরবর্তী মেয়র হিসেবে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মনোনয়নে সম্মতি দিয়েছেন।
রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন, শোভনবাবুকে ছেঁটে ফেলা এবং তাঁর জায়গায় ফিরহাদ অর্থাৎ ববি হাকিমকে মেয়র হিসেবে প্রজেক্ট করাটা রাজনৈতিক দিক থেকে তো বটেই, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও মমতার মাস্টার স্ট্রোক। কারণ, এতদ্বারা তিনি বুঝিয়ে দিলেন, যত প্রিয় এবং যোগ্যই হোন দলের স্বার্থ ও দলীয় শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে কেউ নন। মন্ত্রী মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আচরণে মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা যে বিশেষ বিব্রত বোধ করছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। বিব্রত হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। শোভনের ঘটনা নিয়ে সিপিএম কংগ্রেস বিজেপি’র মতো বিরোধীদের বাড়তি কটু-কাটব্য কটাক্ষের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তাঁকে। এখন এই এত বড় ভোটের মুখে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে সেটা মোটেই প্রীতিকর হচ্ছিল না। বিরোধীদের লাগাতার অপপ্রচারে সাধারণ মানুষের কাছেও একটা ভুল বার্তা যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। তাই, সাময়িকভাবে স্নেহ প্রীতি ভুলে পদক্ষেপ তাঁকে করতেই হয়েছে। তাছাড়া, মোদিবিরোধী জাতীয় রাজনীতিতে এখন অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় তিনি। কিছুদিন আগে চন্দ্রবাবু নাইডুর মতো হেভিওয়েট নেতা এসে প্রকারান্তরে সে কথাই ঘোষণা করে গিয়েছেন। সেই সঙ্গে, মমতার নিজস্ব ফেডারেল ফ্রন্টও আছে। সেটা নিয়েও বিস্তর ভাবনাচিন্তা করতে হচ্ছে তাঁকে। আছে রাজ্যের উন্নয়ন চিন্তা, নানান সমস্যা। সব মিলিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূল সুপ্রিমোর এখন দম ফেলবার সময় নেই। এমন অবস্থায় শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন বিশ্বাসভাজন দক্ষ সহকর্মীর এহেন কাণ্ডে মমতা অসন্তুষ্ট হবেন তাতে আশ্চর্য কী?
তবে, অসন্তোষের বশে কোনও হটকারী সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। কারণ, তিনি মমতা। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি হোক কি বাস্তবতার বোধ—তিনি যে এ রাজ্যের বিরোধীদের চেয়ে কোটি যোজন এগিয়ে—ফিরহাদ হাকিমকে মেয়র করার নিদান দিয়ে সত্যি বলতে কী আবার তার প্রমাণ দিলেন। রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, মন্ত্রী এবং প্রাক্তন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছাড়া এই মুহূর্তে কলকাতা মহানগরীর দায়িত্ব সামলানোর জন্য সবদিক থেকে ফিরহাদ, ববিই যোগ্যতম। কারণ, ববি হাকিম পুরসভা বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং তৃণমূল সরকারে নগরোন্নয়ন দপ্তরের একজন সফল মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় ইতিমধ্যেই রাজ্যের বহু উন্নয়ন পরিকল্পনা সফলভাবে রূপায়িত করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, ববি আর পাঁচজনের চেয়ে অনেক সংযত-বাক এবং রাজনৈতিক বুদ্ধি-কৌশলেও অনেক দড়। ফলে, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েটের বিদায় নিয়ে পুরমহলের আনাচকানাচের আবেগ-আলোড়নগুলোকে সামলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে নগরোন্নয়নের কাজ শুরু করতেও তাঁর সময় লাগবে না। সেদিক থেকেও ববির নির্বাচন যথার্থ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে। এহেন ববির মেয়র পদে আনুষ্ঠানিক যোগদান এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। তার জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনও হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, মমতার এই মাস্টার স্ট্রোকের আর একটি দিকও আছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষকে ডেপুটি করে মমতা কলকাতা উত্তরের মানুষজনের ‘অভিমান’ও মুছে দিলেন। এতদিন শোনা যেত, দিদি মমতা নাকি উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ কলকাতাকে বেশি গুরুত্ব দেন। ভালোর সিংহভাগ দক্ষিণে চলে যায়। আর তাই নিয়ে সূক্ষ্ম একটা অভিমান কলকাতা উত্তরের বাতাসে ভেসে বেড়াত। এবার পুরসভার স্বাস্থ্য দপ্তরের দক্ষ মেয়র পারিষদ অতীনবাবুকে ডেপুটি মেয়রের আসনে বসিয়ে মমতা সেই অভিমান কার্যত মুছে দিলেন। রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সিদ্ধান্ত যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তার চেয়েও বড় কথা, ববিকে মেয়র পদে এনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা কলকাতা পুরসভার ইতিহাসে একটি অনন্য নজির গড়লেন। এই প্রথম মহানগরীর একজন সংখ্যালঘু নেতা কলকাতার মেয়র হচ্ছেন। এটা কি কম বড় কথা? অথচ আশ্চর্য এই, তাঁর নির্বাচন নিয়ে সিপিএম কংগ্রেস থেকে বিজেপি—সকলেই আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে। সকলের আক্রমণের লক্ষ্য অবশ্য শেষ পর্যন্ত সেই মমতা! মেয়র পদে ফিরহাদের মনোনয়ন নিয়ে সিপিএম কংগ্রেস আইনি প্রশ্ন তুলছে, সংশোধিত পুর আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিতর্ক বাধাচ্ছে। আর বিজেপি’র কেউ কেউ তো ঠারেঠোরে সেই চিরচেনা জিগির তুলে হাওয়া গরম করার চেষ্টা করছে। এসব কি রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট দুর্ভাগ্যের নয়? কলকাতার মহানাগরিকের আসনে কোন ধর্ম কোন জাতের মানুষ বসছেন মমতার এই সম্প্রীতির রাজ্যে—এটা কি আলোচ্য হতে পারে! পারে না, কিন্তু হচ্ছে। হোক। তাতে রাজ্যবাসী মানুষজন যে বিশেষ কান দিচ্ছেন না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। বরং, মেয়র পদে ফিরহাদ হাকিমের মনোনয়নকে তাঁরা মমতার ‘মাস্টার-স্ট্রোক’ বলেই মনে করছেন। রাজ্যের পথেঘাটে সাধারণের মন্তব্য থেকে তেমন প্রতিক্রিয়ার আভাসই মিলছে বলে খবর। এ রাজ্যের বাতাবরণে সেটাই তো স্বাভাবিক—তাই না?