মা বলিয়াছেন, ‘‘কর্ম ছাড়া ত থাকা যায় না যতক্ষণ সেই স্থিতি না আসে।’’ ‘সেই স্থিতি’ বলিতে আত্মদর্শনের পর যে স্বরূপস্থিতি হয় তাতেই মা লক্ষ্য করিয়াছেন। যতক্ষণ স্বরূপ স্থিতির উদয় না হয়, এমনকি যতক্ষণ আত্মসাক্ষাৎকার না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কর্ম ত্যাগ করার উপায় নাই। কর্ম করিতেই হইবে, ‘করিব না’ বলিয়া মনে করিলেও বাধ্য হইয়া করিতেই হইবে, না করিয়া উপায় নাই। প্রকৃতি কর্মরূপা—দেহ, প্রাণ, মন প্রভৃতি প্রকৃতিরই কার্যবিশেষ। সুতরাং যতদিন আত্মার দেহপ্রাণাদিতে অভিমানমূলক সম্বন্ধ বিগলিত না হইবে ততদিন কর্ম হইতে অব্যাহতি লাভের কোন উপায় নেই। তবে কর্মের অনেক প্রকারভেদ আছে তাহা সত্য। যাহার যে প্রকার অধিকার প্রকৃতির রাজ্যে তাহার জন্য সেই প্রকার কর্মের ব্যবস্থা আছে। সকাম কর্মের ত কথাই নাই, নিষ্কাম কর্ম ও অভাবের কর্ম বলিয়া আত্মদর্শনের পূর্বের অবস্থার অন্তর্গত জানিতে হইবে। তপস্যা, স্বাধ্যায়, ঈশ্বর-প্রণিধান, যোগাঙ্গের অনুষ্ঠান, উপাসনা, ভজন, সাধন, অন্তর্যোগ, বহির্যোগ জ্ঞানমার্গের অনুশীলন, নৈতিক জীবনেই উৎকর্ষ সাধন, লৌকিক কর্ম— সবই কর্মের অন্তর্গত। এই সকল কর্ম বহু বৈচিত্র্যসম্পন্ন, ইহাদের অনুষ্ঠানে পার্থক্য আছে, অধিকারে ভেদ আছে এবং লক্ষ্যও অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে পৃথক্ বলিয়া মনে হয়; তথাপি সকল প্রকার কর্মই মূলতঃ একই অবস্থার অর্থাৎ অপরোক্ষ আত্মদর্শনের অভাবের সূচনা করে। এমনকি, ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জিত নিষ্কাম কর্মও স্বভাবের অলঙ্খ্য নিয়মের ফল প্রসব করে ও সে ফল কর্মকর্তাকে বাধ্য হইয়া গ্রহণ করিতে হয়। চিত্তশুদ্ধি বা ভগবৎ প্রসন্নতা নিষ্কাম কর্মের ফল। আত্মদর্শন না হওয়া পর্যন্ত স্বরূপ স্থিতির অভাব বশতঃ আপ্তকাম ভাব বা পূর্ণতা আসিতে পারে না। তাই ফলের দিকে লক্ষ্য না থাকিলেও জাগতিক কার্যকারণ নীতির প্রভাবে ফলের উদয় ও কর্তার সহিত তাহার যোগ অনিবার্য হইয়া পড়ে।
সাধারণ সকাম কর্মের কথা বলিবার প্রয়োজন নাই। তাহার মূলে ত মলিন বাসনা নিহিত থাকেই। ঐহিক বা পারত্রিক ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত অতিবড় পুণ্যকর্মও সকাম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মলিন বাসনার স্পর্শ হইতে তাহাও মুক্ত নহে। গুরুর উপর নির্ভর করিয়া নির্বিচারে তাঁহার আজ্ঞা পালন করা— ইহাও সকাম কর্ম। তবে এই ক্ষেত্রে কামনা বা বাসনা বিশুদ্ধ। গুরুর ইচ্ছা পূর্ণ করিবার জন্য যে আন্তরিক বাসনা তাহা বাসনা হইলেও মন্দ নহে। সুধীগণ তাহাকে শ্রেষ্ঠ স্থান দিয়াছেন। এক হিসাবে এই জাতীয় কর্মকে নিষ্কামও বলা চলে। কেহ কেহ তাহা বলিয়াও থাকেন। বৈষ্ণবাচার্যগণ যেমন বলিয়া থাকেন যে ভগবৎ স্বরূপে প্রাকৃত বা হেয় গুণ নাই, তাই তাঁহাকে শ্রুতি নির্গুণ বলিয়া বর্ণনা করেন। কিন্তু তাঁহাতে যে মোটেই কোন গুণ নাই, তাঁহাদের মতে নির্গুণ শব্দের ইহা তাৎপর্য নহে। অপ্রাকৃত অনন্ত কল্যাণগুণ নিত্যই তাঁহাতে আছে, ইহা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তাঁহাকে যে নির্গুণ বলিয়া বর্ণনা করা হয় তাহার উদ্দেশ্য এই যে তিনি যাবতীয় হেয় গুণ হইতে নির্মুক্ত। তদ্রূপ চিত্তে ক্ষুদ্র কামনা বা হেয় বাসনা না থাকিলে এক হিসাবে উহাকে নিষ্কাম বলা চলে। কিন্তু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে উহাকে নিষ্কাম বলা সঙ্গত হয় না। কেহ কেহ মনে করেন, আত্মদর্শন না হইলে নিষ্কাম কর্ম হয় না— এই মত সত্য নহে। মা একথার যথার্থ্য স্বীকার করেন না। কারণ আত্মদর্শন হইলে কর্ম থাকে না। দ্বন্দ্ব ভিন্ন কর্ম হয় না—আত্মদর্শন হইলে দ্বন্দ্বাতীত পদে স্থিতি হয়। তখন আত্মা হইতে ভিন্ন কিছুই দৃষ্ট হয় না, সবই তখন আত্মরূপে প্রতিভাত হয়। তখন দ্বন্দ্বও নাই, কর্মও নাই।
গোপীনাথ কবিরাজ সঙ্কলিত ‘আমি মা আনন্দময়ী বলছি’ থেকে