“শ্রীরামকৃষ্ণের সকল ভক্তের মধ্যে...একজনের প্রতি সহানুভূতি আমি বিশেষভাবে অনুভব করেছি; তাঁর বিষয়ে পড়ামাত্র তাঁকে আমি পছন্দ করে ফেলেছি; তিনি আমাকে গভীর আশ্বাস ও প্রেরণা দিয়েছেন—গিরিশচন্দ্র ঘোষ। কয়েকদিন আগে এক রাত্রে [ইশারউড তখন কলকাতায়] স্টার থিয়েটার তীর্থযাত্রা করেছিলাম। থিয়েটারটির সম্মুখভাগ, এবং ভিতরের দর্শকাসন পুনর্নিমিত হয়েছে, কিন্তু মঞ্চের পিছনে দেখা যাবে—পুরনোকালে থিয়েটারের চেহারা কী ধরনের ছিল, যে-থিয়েটারে শ্রীরামকৃষ্ণ আসতেন, যে-থিয়েটারে এখনো পর্যন্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মঞ্চে প্রবেশের আগে তাঁর ছবির সামনে প্রণাম করে। ...গিরিশচন্দ্র ঘোষ আমার মনে সাড়া জাগান কারণ তিনি আমার মতোই লেখক ছিলেন, আর অধিকাংশ লেখকই যা হয়ে থাকেন তিনি তাই—বোহেমিয়ান। ‘রেস্পেকটেবল্’ বলতে আক্ষরিকভাবে যা বোঝায় তিনি তা ছিলেন না। কঠোর সুনীতিবাদী ব্যক্তিদের তিনি কেচ্ছা-কেলেঙ্কারীতে বিচলিত করতেন। তাঁদের তিনি শিউরে দিতেন। সেটা এমন কিছু বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণকে আমি গভীরভাবে ভালবেসে ফেলি যখন পড়ি যে, গিরিশচন্দ্র বেহেড মাতাল হয়ে মধ্যরাত্রে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে ধরে বসেছেন—তাঁর সঙ্গে নাচতে হবে; শ্রীরামকৃষ্ণ একটুও রাগ না ক’রে, বা গিরিশকে সামান্যতম তিরস্কার না ক’রে, তাঁর সঙ্গে নেচেছিলেন। আমরা পড়ি, শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশকে কতনা প্রশ্রয় দিয়েছেন, স্নেহ-ভালবাসা ও রসিকতার মধ্য দিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন; গিরিশ ঐ অপূর্ব মানুষটির ভালবাসা ও সহিষ্ণুতার প্রভাবে ক্রমে বদলে গেছেন, পরিবর্তনের মধ্যেও নিজের পুরনো রূপ বহুলাংশে বজায় রেখেছেন—সর্বদাই সেই একই জমকালো ঝলমলে ব্যক্তিত্ব। শ্রীরামকৃষ্ণ ও গিরিশের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কের এই রূপটি আমার মন কেড়ে নেয়। শ্রীরামকৃষ্ণ নিঃসন্দেহে তাঁর বহুধা ব্যক্তিত্বের এক অংশে মঞ্চের গৃহদেবতা; কোনো-কোনো দিক দিয়ে সকল শিল্পেরই দেবতা তিনি। যাইহোক, লেখক আমি—গিরিশের যে-অসাধারণ ভক্তি অধ্যাত্মজীবনে তাঁকে উদ্ধার করেছিল, তার একাংশও আমি দাবি করতে পারি না; গিরিশের প্রতিভা বা মদ্যপানের ক্ষমতার অর্ধেকও আমার নেই; তথাপি আমরা কোনো-কোনো দিক দিয়ে আত্মীয়, আর তাই শ্রীরামকৃষ্ণের অপরাপর কঠোর তপস্বী ভক্তদের কাছে নয়, গিরিশের কাছেই প্রেরণার জন্য উপস্থিত হই।”
ইশারউড গিরিশের যে-রূপ এঁকেছেন, সেখান থেকে গিরিশ কিন্তু আরও সরে গিয়েছিলেন। বর্ণোজ্জ্বল আতিশয্যে পূর্ণ গিরিশ প্রশান্ত গভীর হয়ে কোন্ মহনীয় আকার ধারণ করেছিলেন, তার একটা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়েছেন মিসেস গ্রে হ্যালক নাম্নী বিদেশিনী মহিলা। ইনি বেলুড়-মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ-জন্মোৎসবে গিয়েছিলেন এক আমেরিকান ডাক্তারের সঙ্গে—সেখানে ভিড়ের মধ্যে গিরিশকে দেখেন, এবং অবিলম্বে আকৃষ্ট হন।
‘ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ’ থেকে