গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
বস্তুত বৈরাগ্য বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক মনে হলেও তার মধ্যে নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুটি দিকই আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যাখ্যায় তা হল সংসারে বিরাগ, যা নেতিবাচক এবং ঈশ্বরে অনুরাগ, যা ইতিবাচক। সংসার বিরাগের যথার্থ অর্থ সংসারের প্রতি আসক্তি ত্যাগ। কারোর ক্ষেত্রে সেই ত্যাগ বাহ্যিক ও মানসিক উভয়ই, কারোর ক্ষেত্রে তা কেবল মানসিক। শক্তিসন্ধানী মানুষের পক্ষে উপরোক্ত বৈরাগ্যের চর্চা পরিহার করা সম্ভব নয়। কারণ, শান্তিলাভের বিকল্প অন্য কোনও পথ নেই বললেই চলে। উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ সঙ্কীর্ণ অর্থে বৈরাগ্যের চর্চা না করলেও তাঁর ঈশ্বরপ্রেম ও অনাসক্তি সাধনার মধ্য দিয়ে বৈরাগ্যের অন্তরঙ্গ সাধনা করেছিলেন।
মায়াবাদ ও অদ্বৈত অনুভূতি
মায়াবাদ অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম তত্ত্ব—যা নিয়ে কম বিতর্ক নেই এবং সে বিতর্কের মূল কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘মায়াবাদ’ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা রবীন্দ্রনাথ মায়াবাদের বিরূপ সমালোচক হলেও মায়াবাদ প্রসঙ্গে তাঁর এই মন্তব্যটি অনুধাবনযোগ্য—যা তাঁর আত্ম-উন্মোচকও বটে: ‘আমি যে অনুভব করছি, মিথ্যার বোঝায় আমার জীবন ক্লান্ত। আমি যে দেখতে পাচ্ছি, যে পদার্থটাকে আমি বলে ঠিক করে বসে আছি তারই থালা ঘটি বাটি, তারই স্থাবর অস্থাবরের বোঝাকে সত্যপদার্থ বলে ভ্রম করে সমস্ত জীবন টেনে বেড়াচ্ছি—যতই দুঃখ পাই কোনোমতেই তাকেই ফেলতে পারি নে। অথচ, অন্তরাত্মার ভিতরে একটা বাণী আছে, ও-সমস্ত তোমাকে ত্যাগ করতেই হবে। ... এই বৈরাগ্য যে সমস্ত উপকরণের ধাঁধার মাঝখানে পথভ্রষ্ট বালকের মতো থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। তবে আমি মায়াবাদকে গাল দেব কোন্ মুখে! আমার মনের মধ্যে যে এক শ্মশানচারী বসে আছে, সে যে আর- কিছুই জানে না, সে যে কেবল জানে—একমেবাদ্বিতীয়ম্।’
পরোক্ষে হলেও অদ্বৈত বেদান্তের চরম অনুভূতিবান পুরুষ সম্পর্কে তাঁর সশ্রদ্ধ মন্তব্যও কম প্রণিধানযোগ্য নয়: ‘যিনি খণ্ড কালের সমস্ত খণ্ডটা সমস্ত ক্রমিকতার আক্রমণ থেকে ক্ষণকালের জন্যও বিমুক্ত হয়ে অনন্ত পরিসমাপ্তির নির্বিকার নিরঞ্জন অতলস্পর্শ, মধ্যে নিজেকে নিঃশেষে নিমজ্জিত করে দিয়ে সেই স্তব্ধ শান্ত গম্ভীর অদ্বৈতরসসমুদ্রে নিবিড়ানন্দের নিশ্চল স্থিতি লাভ করেছেন তাঁকে আমি ভক্তির সঙ্গে নমস্কার করি। এখানে উল্লিখিত ‘অদ্বৈতসমুদ্রে নিশ্চল স্থিতিলাভের নিবিড়ানন্দ’ আর নির্বিকল্প সমাধির তথা অদ্বৈতসিদ্ধির ঘনীভূত দিব্যানন্দ এক নয় কি—যার অভিজ্ঞতা ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষদের জীবনে হয়ে থাকে?
এতদ্সত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে সৌন্দর্যের পূজারি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত প্রবৃত্তিমার্গের আদর্শে বিশ্বাসী। বহিঃসৌন্দর্যের পূজারি রবীন্দ্রনাথ মূলত প্রবৃত্তিমার্গের আদর্শে বিশ্বাসী। বহিঃসৌন্দর্যের দ্বারপথ দিয়ে অন্তঃসৌন্দর্যের অন্তঃপুরে অভিসার, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয়াতীত আনন্দের অভীপ্সা, বন্ধনের মধ্য দিয়ে বন্ধনাতীতের স্বাদলাভ—এই তাঁর ভাব ও সাধনা। নিবৃত্তিমার্গের সাধনার মতো কঠিন না হলেও এই ভাবের সাধনাও কম দুরূহ নয়। কারণ, এই সাধনায় যেমন প্রয়োজন ঈশ্বরের প্রতি সুগভীর বিশ্বাস ও ভালবাসা তেমনই প্রয়োজন সংযম ও অনাসক্তি।
চিত্ত রবে পরিপূর্ণ অমত্ত গম্ভীর
হৃদয়হীন শুল্ক আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে রবীন্দ্রনাথ যেমন মেনে নিতে পারেননি তেমনই ভক্তির আবেগে হৃদয়বৃত্তির সাময়িক উদ্বেলতা তথা ভাবোচ্ছ্বাসকেও তিনি সমর্থন জানাননি। ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে, লোকব্যবহারের ক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ির যে পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল তা হল: ভাব বা ব্যবহার হবে সংযত, মার্জিত ও পরিশীলিত। রবীন্দ্রনাথ শুধু সে ধারা অনুসরণ করেননি, তাঁর ব্যক্তিপ্রকৃতি ও যুক্তিও তার পক্ষে ছিল। তিনি লিখেছেন—যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে/মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে/ভাবোন্মাদমত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা/উদ্ভ্রান্ত উচ্ছ্বল ফেন ভক্তি মদধারা/ নাহি চাহি নাথ।
স্বামী মেধসানন্দের ‘রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচেতনা ও শ্রীরামকৃষ্ণ-প্রসঙ্গ’ থেকে