যারা বিদ্যার্থী তাদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। নানা বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব জাগবে। গোপন প্রেম থাকলে ... বিশদ
সেই সর্বোচ্চ বস্তু নিজে ইচ্ছা করিয়া বহু সাজিয়াছেন। জলের মধ্যে কাঁচের অনেকগুলি পাত্র রাখিলে এক জল যেমন বিভক্ত হইয়া পড়ে, মনে হয়, এই ব্যাপারটা কতটা সেইরূপ। সর্বব্যাপী ব্রহ্ম যে কাঁচের মত ঘরটা দিয়া জলকে আলাদা করিয়া রাখিয়াছেন তাহাকে আমরা বলি তাঁহার বিদ্যামায়া, আবরণ শক্তি বা আনন্দময় কোশ। বিদ্যামায়া এই জন্ম যে এই মায়া আমার জ্ঞান অর্থাৎ আমি যে সত-চিৎ-আনন্দ তাহা ভুলায় না, আমি ব্রহ্মের এক জাতীয়—ব্রহ্ম অন্তহীন, আমি সান্ত, আমি যেন ব্রহ্মের এক কণিকা। আবরণ শক্তি বলা হয় এই জন্য যে—আমার অনন্তত্ব তাহা আবৃত করিয়া রাখে। এই আবরণ করিবার শক্তি ব্রহ্ম নিজেই, তিনিই একখানা খাপের মতন হইয়া, যেন খাপ সাজিয়া, নিজের অঙ্গের এক অংশ মূল অঙ্গ হইতে আলাদা করিয়া রাখিয়াছেন। তাই বলি ইহা আনন্দময় কোষ। সচ্চিদানন্দ নিজের আনন্দ নিজে সম্ভোগ করিবার জন্য নিজেই নিজের মধ্যে এক কল্পিত ভেদ রচনা করিয়াছেন। ক্ষুদ্র অংশ বৃহতের সৌন্দর্য মাধুর্য্য অমিত শক্তি সামর্থ্য সম্ভোগ করিয়া, জ্ঞান প্রেমে তন্ময় হইয়া রহিয়াছেন—যেমন বিবেকানন্দ রূপী আত্মা সপ্তর্ষিমণ্ডলে আছেন, যেমন তিনি বিবেকানন্দত্ব অবলম্বন করিয়া “রামকৃষন-বেশরূপ” মানুষকে প্রদর্শন করিয়াছেন।
পরমাত্মার দারুণ আকর্ষণ সুখ দুঃখের অপূর্ব সংমিশ্রণ। শ্রীগৌরাঙ্গদেবের বিরহ মিলনের কাহিনী বইতে পড়িয়া বুক ফাটিয়া যায়; শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবনেও অবিকল সেই দারুণ বেদনা। আবার নরেনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বুকে গামছা নিড়োনো এবং শ্রীরামকৃষ্ণের নাম শুনিলে বিবেকানন্দের বিষম ব্যাকুলতা আনন্দময় কোষে অবস্থানের অবস্থার ঐতিহাসিক প্রমাণ। ঐতিহাসিকই বা বলিব কেন? শ্রীরামকৃষ্ণপত্নী ও শিষ্যদের প্রত্যক্ষদ্রষ্টাতে এখনও আছেন বহু।
এই অবস্থার মাধুর্য্য সম্ভোগের জন্য নীচে নামতে হল। অসম্ভব সম্ভব হলো ব্রহ্মের অবিদ্যা মায়ার সাহায্যে। অবিদ্যার আবরণ আনন্দময় কোষের উপর বসাইয়াছিল এক অতি কঠিন ইস্পাতের কৌটাঢাকনি বা কোষ!! “সত-চিৎ-আনন্দ” আনন্দময় কোষাবৃত চৈতন্য বা প্রেমিক জ্ঞানী জীব সর্বতোভাবে, সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়া গেলেন তাঁহার স্বরূপ।
তিনি ছিলেন ক্ষয় ব্যয় ধ্বংস রহিত “সৎ”, এখন তিনি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস, একেবারে ‘নাই’ হইয়া গেলেন। তিনি ছিলেন পূর্ণজ্ঞানময় সত্ত্বা, এখন জ্ঞান লেশহীন সম্পূর্ণ অচেতন প্রস্তরবৎ; তিনি ছিলেন দুঃখলেশহীন পূর্ণানন্দ, এখন তিনি বোধ রহিত জড়—আনন্দ বুঝিবে কে? নিত্য আমরা গাঢ় নিদ্রাবস্থায় ঐ অবিদ্যা আবরণ অনুভব করি। এখন আমরা ঐ অবিদ্যায় ঢাকা আত্মবিস্মৃত এক বিপরীত সত্ত্বা!!
এইবার আমার আর এক জীবন আরম্ভ হইল। আমি যেন অতি ক্ষুদ্র এক কণা ‘হুস্’—আর কিছুই জানি না, দেখি না, শুনি না বুঝি না। এখন আমি শুধু ‘আছি’ এইটুকু বোধ করি, আর কোনও বোধই নাই। আমার সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী হইয়া আমি এক দারুণ চাপের মধ্যে আছি। আমার অজ্ঞাতসারেই আমি যেন কি একটা পাইবার জন্য হাতড়াইতে চাই, আমার আমি হইতে বাহির হয় একটী শক্তি তাহা বিদ্যুতের মত সংবাদবাহী। কিন্তু হাতড়াইবার স্থল নাই ধরিবার মত বস্তু নাই!! মন ফিরিয়া আসে আমিতে!