বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
দেহ ও মন এই দুইটী যন্ত্র-সহায়ে তোমার আভ্যন্তরীণ শক্তিপুঞ্জ প্রয়োজিত এবং অভিব্যঞ্জিত হইতেছে। দেহ যদি একটী দশ-মর্দ্দা হইয়া থাকে, মন তাহা হইলে একটি বিশ-মর্দ্দা। “মারো ধাক্কা হেইয়োঁ”—বলিয়া দশ-মর্দ্দা দিয়া ধাক্কা দাও, গায়ে তৎক্ষণাৎ জোর আসিবে, কার্য্য-সিদ্ধি ত’ হইবেই। প্রয়োগেই শক্তির উপচয় এবং সার্থকতা, অবশ্য অপপ্রয়োগে নহে।
ভাঙ্গা দেহে মনটা তেমন স্বচ্ছন্দে থাকে না, তথাপি সে জগৎ-কল্যাণেচ্ছা সব সময়ই করিতে পারে। মেরামত করিবার সরঞ্জাম ও উপাদান থাকিলে দ্রুত মেরামত করিয়া লও, আলস্য করিও না। তাহা না থাকিলে মূল-মিস্ত্রী ভগবানের হাতে মেরামতের ভার দিয়া নিশ্চিন্ত হও এবং অক্ষুব্ধ চিত্তে জগতের কল্যাণ-চিন্তাতে তৎপর হও। গরীব বাড়ীওয়ালা যেমন ভাঙ্গা বাড়ী ভাড়া দিয়া ভাড়াটিয়ার টাকাতেই ঘর-দুয়ার মেরামত করিয়া লয়, তুমিও জগত-কল্যাণের কর্ম্মী, মনটীকে সহ দেহ-ঘর ভগবানকে ভাড়া দিয়া ঘর মেরামতের উপায় দেখ। এ দেহ যখন জগত-কল্যাণই করিবে, তখন সকল কল্যাণের সূত্র যিনি হাতের মুঠে ধরিয়া রাখিয়াছেন, তিনি ইহাকে জগতের কাজের উপযোগী করিয়া লইবেনই। ইহা তাঁহারই নিজ গরজ। তুমি ভুবন-মঙ্গল-তরে ভগবানের হাতে দেহ-মন সমর্পণ করিয়া দাও। তুমি আত্মসমর্পণ করিয়াই খালাস পাইয়াছ জানিও—পরবর্ত্তী খাটুনী তাঁর, যিনি ইহার মালিক হইলেন। পাহাড়-পর্ব্বতে ভরা, বন-জঙ্গলে বোঝাই একটা অপয়া জমি তুমি অপরের কাছে বিক্রী করিয়া দিয়াছ, তোমার প্রাপ্যগণ্ডা—ধর, আত্মপ্রসাদ ও নিশ্চিন্ততা,—তুমি গণিয়া বুঝিয়া ঘরে আনিয়া সিন্দুকে তুলিয়াছ, এখন যদি এ পাহাড় কাটিয়া সমতল করিতে হয়, এ জঙ্গল উপড়াইয়া আবাদী জমি করিতে হয়, খন্তা-কোদাল বা দা-ছুরির দাম এবং লোক-লস্কর, কুলী-মজুর প্রভৃতির পারিশ্রমিক তোমাকে বহন করিতে হইবে না। যাঁর জমি তিনি পারেন ত’ পাহাড় কাটিবেন, না পারেন ত’ বসিয়া থাকিবেন, উহাতে তোমার কি? ইচ্ছা হইলে তিনি ডিনামাইট বিদারণ করিয়া পাহাড়ের পাথর চুরমার করিবেন নতুবা কামান দাগিয়া পর্ব্বতের চূড়া উড়াইয়া দিবেন, এই সবের উপরে তোমার আর কথা কহিবার কিছু নাই।
ইচ্ছার শক্তি অলঙ্ঘ্য। “এই দেহ জগতের কল্যাণে লাগুক”, এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে ইহা জগতের কল্যাণে লাগিয়া যায়। যে যাহার যোগ্য, সে সেই কাজেই আসে। ছাগল দিয়া জমি-চাষ চলে না; ইঁদুর দিয়া যুদ্ধ চালান যায় না। চাষের কাজে চাই গরু-মহিষ; যুদ্ধের কাজে চাই হাতী-ঘোড়া। তুমি কি মনে করো, তোমার দেহ জগৎ-কল্যাণে অযোগ্য থাকিতে তাহা কাজে লাগিবে? কাজে আসিবার আগে ইহার মধ্যে যোগ্যতার সঞ্চার হওয়া চাই। আকাঙ্ক্ষার ঐকান্তিকতা ইহাতে যোগ্যতা আনিবে; অযোগ্যতা দূর করিবে। “নাই-নাই” বলিতে বলিতে সাপের বিষও দূর হইয়া যায়। “নাই—নাই” বলিতে বলিতে অযোগ্যতাও দূর হইয়া যাইবে না কেন?
মনের ইচ্ছা যখন দেহের মধ্য দিয়া কার্য্যরূপে প্রকাশ পাইতেছে দেখিবে, তখনই বুঝিবে যে, দেহ কল্যাণ-কর্ম্মে কিছু যোগ্য হইয়াছে। মনে যখন জাগিল, ব্রহ্মচর্য্য প্রচার করিতে হইবে, তখন তাহার প্রকৃত বহির্বিকাশ কিছু নাও থাকিতে পারে। ক্রমশঃই যখন এই কথাটা বারংবার মনে জাগিতে থাকিবে, তখন চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতে দেহটা একটু গঠন পাইবেই; কারণ, চিন্তায় দেহের আণবিক রূপান্তর ঘটে। তখন তোমার নিজের জীবনে আগে ব্রহ্মচর্য্য-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আরম্ভ হইবে। কারণ, নিজে আচরণ না করিয়া অবতার-খ্যাত মহাপুরুষেরাও জগতে কোনও সংস্কার প্রবর্ত্তন করিতে পারেন নাই। নিজে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিতে গিয়া চিন্তার ঐকান্তিকতা ও প্রগাঢ়তা আরও বাড়িয়া যাইবে। তখন দেহের আণবিক রূপান্তর আরও দ্রুততর ও সুষ্ঠতর হইতে থাকিবে। তখন দেখিবে, মনের কথা আর মনে চাপিয়া রাখা যায় না, অজ্ঞাতসারে তাহা বাহিরিয়া পড়ে। কিন্তু মুখে বলিয়া কয়জনকে তোমার কথা শুনাইতে পার?
শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দের পরমহংসদেবের ‘আপনার জন’ থেকে
