উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
সমাধির অবশ্যম্ভাবী ফল তাই প্রজ্ঞা। যে-সমাধির ফলে প্রজ্ঞা ফোটে না, তা সমাধি নয়, ব্যাধি। শুধু দেহের নিস্পন্দতাই সমাধি নয়, এটা তন্ময়তার একটা আনুষঙ্গিক বাহ্য লক্ষণমাত্র। কিন্তু তন্ময়তা সেই গভীর অতলে পৌঁছাল কিনা, সেখানে ডুবুরির মতো ‘হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে’ ডুব দিয়ে প্রজ্ঞার অমূল্য মণি-মাণিক্য, অরূপ-রতন তুলে আনা গেল কিনা, তারই উপর সমাধির সার্থকতা যাচাই হয়ে থাকে। সমাধি সম্বন্ধে আমাদের এত ভ্রান্ত ধারণা যে, সামান্য হৃদয়াবেগ উচ্চগ্রামে ওঠার ফলে যদি দৃষ্টি স্তিমিত হয়, অঙ্গ শিথিল হয়, ইন্দ্রিয়বর্গ স্তব্ধ হয়, প্রাণস্পন্দ নিরুদ্ধ হয়, অমনি আমরা মনে করি সমাধি লাভ হয়েছে। আমরা ভুলে যাই সমাধি চেতনার আলোর বিষ্ফারণ, প্রজ্ঞাজ্যোতির সমুদ্ভাসন, যার ফলে হয় যোগজ প্রত্যক্ষ।
এখানেই এসে পড়ে প্রমাণের প্রশ্ন। প্রমাণ অর্থাৎ জ্ঞানের যেটি করণ বা সাধন অর্থাৎ উপায়, তারই নাম প্রমাণ। আমাদের জ্ঞানলাভের মোটামুটি তিনটি হাতিয়ার বা করণ— প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম। কোন কোন দর্শনে প্রমাণের সংখ্যা বাড়িয়ে চার, পাঁচ, ছয়, এমনটি দশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু মূলত দেখতে গেলে এই তিনের মধ্যেই সব অন্তর্ভুক্ত। আবার এই-তিনও আসলে একে এসেই পর্যবসিত হয় অর্থাৎ সব প্রমাণই প্রত্যক্ষমূলক। প্রত্যক্ষকে ভিক্তি করেই... অনুমান ও আগমের প্রসার ও প্রামাণ্য।
চেতনার আলো ইন্দ্রিয়ের গবাক্ষপথে বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের বাইরের জগৎকে যতটুকু দেখিয়ে বা জানিয়ে দেয়, তারই উপর আমাদের জ্ঞান নির্ভরশীল। এর ফলে আমাদের জ্ঞান খুবই সংকুচিত ও সীমাবদ্ধ। দূরের জিনিস বা সূক্ষ্ম জিনিস ইন্দ্রিয় দেখতে পারে না, সেখানে আমরা অনুমান বা আগমের আশ্রয়ে আমাদের জ্ঞানকে আর একটু ব্যাপক করে নিই। দূরে যে আগুন আছে ধোঁয়া দেখে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হই। বিলেতে নিজে না গিয়েও অন্য প্রত্যক্ষ দর্শীর মুখে শুনে সেখানকার যথাযথ জ্ঞান আহরণ করি। কিন্তু অনুমান ও আগমের মারাত্মক ত্রুটি হল যে তারা প্রামাণিক অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান দেয় বটে, কিন্তু সেটি কী ধরণের আগুন তার কোনো বিশেষ পরিচয় অনুমান আমাকে এনে দিতে পারে না। আগম সম্বন্ধেও সেই কথা। বিলেতের সাধারণ পরিচয় অন্যের মুখ থেকে শুনে বা বই পড়ে হতে পারে বটে, কিন্তু বিশেষ জ্ঞান একমাত্র সেখানে গেলেই হতে পারে, অন্যথা সম্ভব নয়।
যোগদর্শন তাই সাধারণ সব প্রমাণকেই বাতিল করলেন কারণ প্রমাণগুলিও সবই বৃত্তি অর্থাৎ চিত্তের পরিণাম। আর চিত্তবৃত্তিনিরোধই যোগের লক্ষ্য। প্রমাণের যে সামান্য আলোটুকু ছিল, তাও নিভিয়ে যোগদর্শন কোন্ অন্ধকারের অতলে ডুব দিতে চাইলেন? জগৎ তো তাহলে মুছে গেল, দেখবার, শুনবার, জানবার সব উপকরণ সরিয়ে ফেলা হল। রইল কি তাহলে অভাব বা শূন্যতা বা গাঢ় অন্ধকারময় নিদ্রার মতো অবস্থা? অভাবকে অবলম্বন করে যে নিদ্রা দেখা দেয়, যোগদর্শন তাকেও একরকম বৃত্তি বলেই চিহ্নিত করেছেন, ‘অভাবপ্রত্যয়ালম্বনা বৃত্তিনিদ্রা’। এও চিত্তের আর একরকম পরিণাম বা বিকার, একেও রুদ্ধ করতে হবে। ভাবের জগৎও রুদ্ধ প্রমাণের অভাবে, অভাবের জগৎও বিলুপ্ত নিদ্রার নিরোধে।
গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ‘চেতনার আরোহিণী’ থেকে