যারা বিদ্যার্থী তাদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। নানা বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব জাগবে। গোপন প্রেম থাকলে ... বিশদ
আমার দিকে চাহিও না। আজ কথা কহিতেছি, কাল চুপ মারিতে পারি। পথে যখন নামিয়াছ, পশ্চাদ্-দৃষ্টি রুদ্ধ কর, অনন্ত সম্মুখেই দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া দাও। মরিলেও আর ফিরিবে না, সঙ্কল্প- সাধন না করিয়া ছাড়িবে না,—এই জিদ্ কর। যাহা আমি একটী দেহ ও একটী মন দিয়া করিতাম, তোমরা তাহা শত জনে শত দেহ লইয়া শত মন লইয়া কর। সুমাহান্ ধর্ম্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা কর, অসত্যের সহিত দুর্ব্বার সংগ্রামে নিত্য নূতন সাম্রাজ্য জয় কর।
নিবিড় তপস্যার অগোচর গুহা হইতে ভাবের অভ্যুদয় হয়, মানব-জীবনের ছোট-বড় কর্ম্মচেষ্টায় এবং তদ্বিষয়িনী আলোচনায় উহার পরিপুষ্টি ও প্রসার হয়। ভারতের লক্ষ কোটি গুপ্ত গুহার তপস্যা এখনও প্রচার পায় নাই, তোমাদিগকে উহা প্রচারিত করিতে হইবে। অপরিমেয় জাতীয় সম্পদ এখনও কত বৃক্ষ-কোটরে কত বালুকা-বিস্তারে প্রচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে, তোমরা তাহা খুঁজিয়া বাহির করিবে এবং জাতি-বর্ণের বিচার না মানিয়া নিরপেক্ষভাবে সকলের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিবে।
এই গুরুভার-দায় তোমাদেরই স্কন্ধে ন্যস্ত রহিয়াছে। কিন্তু নিজেদের ভিতরে তপঃশক্তির অন্ততঃ প্রাথমিক উন্মেষটুকুও না ঘটিলে গুপ্তধন লাভের কোন যোগ্যতাই জন্মিবে না, তুমি আবার কাহাকে কি বিতরণ করিবে? শূন্য হস্তে দাতৃত্বের অভিনয় যে বড়ই বিড়ম্বনা! মনের সকল বিক্ষিপ্ততাকে দূর করিয়া, আবেগাকুল ভোগাকাঙ্ক্ষাকে সুসংযত করিয়া, ইন্দ্রিয়ের শতমুখ প্রলোভনকে পরাজিত করিয়া, আত্মসুখের নির্লজ্জ অভিযানকে পর্য্যুদস্ত করিয়া দিয়া, এক আদর্শ এক লক্ষ্য ধরিয়া চলিলে, একই উদ্দেশ্যের পরিসমাপ্তিকল্পে দেহের ও মনের সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করিলে, তবে তোমাতে তপঃশক্তির অঙ্কুর গজাইবে। চাই একাগ্রতা ও একনিষ্ঠা, চাই মৃত্যুপণ করিয়া প্রয়াস। তবে তুমি নিজে জ্ঞান লাভ করিবে, পরকে জ্ঞান দিতে পারিবে।
তপস্বীর কথাই কথা, উচ্ছাস না থাকিলেও উহাতে সুপ্ত শক্তির উদ্বোধন হয়, উত্তেজনা না থাকিলেও উহাতে বিদ্যুত-প্রেরণা জাগ্রত হয়। কারণ, তপস্বীর কথা অনুভূতি-সিদ্ধ, ভাব-যোগে নিত্য-প্রত্যক্ষ, অতএব অকাট্য। মানুষের প্রাণ জাগাইতে চাই প্রাণবত্তা। কথার মাঝে যতটুকু প্রাণ ঢালিয়া দিতে শিখিয়াছ, ততটুকুই তুমি মানুষের প্রাণ জাগাইয়া দিয়াছ। অকপট ভাবই প্রকৃত ভাব, কপটের ভাব অ-ভাবেরই নামান্তর মাত্র।
ভাবই মনুষ্য-সমাজের সংগঠনী ও সম্মিলনী শক্তিটুকুকে ধরিয়া রাখিয়াছে, ভাবের বৈচিত্র্যই সমাজের অঙ্গে অঙ্গে অপূর্ব্ব বিচিত্রতার রেখাপাত করিয়া দিয়াছে। ভাবই মানুষকে ত্যাগী করিয়াছে, সংযমী করিয়াছে, পরার্থে সর্ব্বস্ব-উৎসর্গকারী সন্ন্যাসী করিয়াছে। আদান-প্রদানের নিয়ম অনুসরণ করিয়া নয়, হিসাব-নিকাশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতাইয়া নয়, যুক্তি-বিচার-বিতর্কের অফুরন্ত জের টানিয়া নয়, একমাত্র ভাবের বলেই মানুষ যুগে যুগে দেশকে ভাল বাসিয়াছে, জাতিকে ভালবাসিয়াছে, জগৎকে ভালবাসিয়াছে, ধর্ম্মকে ভালবাসিয়াছে এবং ভালবাসার বস্তুর জন্য অবহেলে কাঁচা মাথা নিজ হাতে কাটিয়া দিয়াছে।
যেখানে কাপট্য নাই, পাটোয়ারী বুদ্ধি নাই, জিলাপির প্যাঁচ নাই, সেখানে ভাব বিশ্বজয়ী। তোমরা আলেক্জান্দার, সীজার বা তৈমুরের অপেক্ষা বড় দ্বিগ্বিজয় করিতে বাহির হইয়াছে,—তোমাদের ঢাল-বর্ষা, তীর-ধনুক সবই ঐ একমাত্র ভাব। যোদ্ধার অসিতে মরিচা ধরিলে তার কি আর যুদ্ধজয় হয়?
শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দের পরমহংসদেবের ‘আপনার জন’ থেকে