বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
বিদ্যোৎসাহী শ্রীরামকৃষ্ণের বিদ্যার প্রতি প্রীতি ও বিদ্যার বিষয় নির্বাচনের দিকে সজাগ দৃষ্টি সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি নিরক্ষর শিষ্য লাটুকে পড়াতে সচেষ্ট হয়েছেন। শিষ্য কালীপ্রসাদকে বিদ্যাচর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন, আবার শিষ্য শশিভূষণকে অবান্তর কোন গ্রন্থ পড়তে নিষেধ করেছেন। নরেন্দ্রনাথকে জ্ঞানবিচার করতে উৎসাহিত করেছেন। আবার অত্যধিক তর্কবিচারের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা দেখে তিনি মহেন্দ্রনাথকে তর্কবিচারের মাথায় বজ্রাঘাত করতে বলেছেন। বিদ্যাকে কিভাবে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে হয় তিনি তার দিঙ্নির্দেশ করেছিলেন।
আরো কথা। ঠাকুরের উপদেশের সবকিছু প্রচলিত শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ঠাকুর বহুবার বলেছেন যে, বেদে হোমাপাখির উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বহু সন্ধানেও বেদের কোন অংশে হোমাপাখির সন্ধান পাওয়া যায়নি। যোগবাশিষ্ট গ্রন্থে একটি শ্লোক পাওয়া যায়—‘‘অন্তরীক্ষেহপি জায়ন্তে আকাশবিহগাদয়ঃ। / বনবীথিষু জায়ন্তে সিংহব্যাঘ্রমৃগাদয়ঃ।’’ তার টীকাতে রয়েছে: ‘‘আকাশবিহগাঃ ক্ষুদ্রপক্ষিবিশেষাঃ তে হি সদা ভ্রমন্তঃ অন্তরীক্ষ এব প্রসূয়ন্তে, প্রসূতং চ অন্ডম্ অধঃপাতাৎ প্রাগেব ভিত্ত্বা নির্গতাঃ শাবকাঃ সদ্যসঞ্জাত-পক্ষী অন্তরীক্ষমেব উৎপত্য ভ্রমন্তীতি; লোকপ্রবাদপ্রসিদ্ধঃ’’। এই বর্ণনার সঙ্গে ঠাকুরের বিবরণ হুবহু মিলে যাচ্ছে। টীকাকারের মতে এই কাহিনীর উৎস লোকপ্রবাদ। এক্ষেত্রে ‘ব্যোম,’ ‘হোমা’ —এইরূপ শব্দটির বিবর্তন কল্পনা করা দোষণীয় হবে না আশা করি। অনেকে মনে করেন, অধুনা-লুপ্ত কোন বেদাংশের মধ্যে এটি নিশ্চয়ই ছিল।
এটাও লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, ঠাকুর কোথাও শাস্ত্রমুখে বলেছেন, কখনো বা নিজের কথা বলছেন। বহুস্থলে তিনি ‘গীতা বলেছে’, ‘অধ্যাত্ম বলেছে’, ‘ভরদ্বাজ বলেছেন’ বা ‘ঋষিরা বলেছেন’— এরূপ ভূমিকা করে শাস্ত্রবাণী উদ্ধৃত করেছেন, আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন উৎস উদ্ধৃত না করে বলেছেন। সেগুলি বিশ্লেষণ করে তাদের শাস্ত্রভিত্তি প্রমাণ করা কঠিন নয়। যেমন তিনি বলছেন: ‘‘অধ্যাত্মরামায়ণে আছে, রামকে দর্শন করে যত ঋষিরা কেবল এই কথাই বলছে, হে রাম, তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ করো না।’’ তিনি অন্যত্র বলেছেন: ‘‘যাকে বেদে ‘সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণঃ’ বলেছে।’’ শ্রীরামকৃষ্ণ কাপ্তেনকে বলছেন: ‘‘শ্রীমদ্ভাগবতে জ্ঞানীর চারটি অবস্থার কথা আছে—(১) বালকবৎ (২) জড়বৎ (৩) উন্মাদবৎ (৪) পিশাচবৎ। পাঁচবছরের বালকের অবস্থা হয়। আবার কখনো পাগলের মতো ব্যবহার করে। কখনো জড়ের ন্যায় থাকে।’’
শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, সব শাস্ত্র সব কালে প্রযোজ্য নয়। তিনি নিষ্ঠাবান ঈশান মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন: ‘‘কলিকালে বেদমত চলে না। জীবের অন্নগত প্রাণ, আয়ু কম, দেহবুদ্ধি, বিষয়বুদ্ধি, একেবারে যায় না।’’ অন্যত্র বলেছেন: ‘‘কি জান, এখন কলিযুগে বেদমত চলে না। একজন বলেছিল, গায়ত্রীর পুরশ্চরণ করব। আমি বললুম, কেন? কলিতে তন্ত্রোক্ত মত। তন্ত্রমতে কি পুরশ্চরণ হয় না?’’ শশধর তর্কচূড়ামণিকে তিনি বলেছিলেন: ‘‘... আমি লোকেদের বলি, তোমাদের আপোধন্যন্যা—ও-সব অত বলতে হবে না। তোমাদের গায়ত্রী জপলেই হবে।’’
আদর্শবাদী শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই বাস্তবধর্মী। তিনি বলতেন, ভবনদী পার হওয়ার জন্যই শাস্ত্রের প্রয়োজন। বিষয়টি মনে গেঁথে দেবার জন্য একটি কাহিনী ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। গঙ্গা পার হচ্ছিল কয়েকজন। একজন ছিলেন পণ্ডিত, বিদ্যার গর্বে স্ফীত। পণ্ডিত একজনকে জিজ্ঞাসা করল: ‘বেদান্ত জান?’ সে বলল: ‘আজ্ঞা, না।’ ‘তুমি সাংখ্য পাতঞ্জল জান?’ —‘আজ্ঞা, না।’ ‘দর্শন-টর্শন কিছুই পড় নাই?’— ‘আজ্ঞা, না।’ পণ্ডিত বড়াই করে নানা কথা বলতে থাকে। লোকটি চুপ মেরে বসে থাকে। এমন সময় উঠল ভয়ঙ্কর ঝড়—নৌকা ডুবু ডুবু হলো। সেই লোকটি বলল: ‘পণ্ডিতজী, আপনি সাঁতার জানেন?’ পণ্ডিত বলল: ‘না’। সে বলল: ‘আমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জানি না, কিন্তু সাঁতার জানি।’ ভবনদী পার হওয়া যায়, মানুষজীবনের পরম প্রাপ্তব্য লাভ করা যায়। গীতা বলেছেন: ‘‘যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।’’ এই লক্ষ্যে সাধককে যো-সো-করে পৌঁছাতে হবে।