কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
চাতক মেঘের আশাপথ চাহিয়া বসিয়া আছে, কবে নবনীরদ নীল গগনাঙ্গন নিজ রূপজ্যোতিতে আলোকিত করিয়া বারিবিদ্ধ বর্ষণে ধরাতলকে সুশীতল করিবে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহারও পিপাসার শান্তি হইবে। কতদিন ফটিকজল এই কাতর প্রার্থনায় নীলাম্বরের জলধর আসিল বটে, কিন্তু তাহার পিপাসার শান্তি হইতে না হইতে সে প্রাণত্যাগ করিল, কৈ চাতক তাহা তো চাহে নাই?
পুত্রকে শিক্ষিত করিবার জন্য পিতা তাহাকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করিলেন, আশা—পুত্র শিক্ষিত হইলে বৃদ্ধ বয়সে তাহাকে আর কষ্টভোগ করিতে হইবে না। কিন্তু পুত্র হয়তো বিদ্যার পরিবর্ত্তে কুসঙ্গ লাভ করিয়া অধঃপতনের শেষ সোপানে অবতরণ করিল, কালে পিতাকে প্রহার পর্য্যন্ত করিতে কুণ্ঠিত হইল না। অথবা পুত্র শিক্ষিত হইয়াও ঔদাস্য বা কার্যের ব্যস্ততায় পিতার সংবাদ লইবার অবকাশ পাইল না, আপনার কর্ম্মস্থলে পত্নীপুত্র লইয়া সুখে স্বচ্ছন্দের বাস করিতে লাগিল; আর উত্থানশক্তিহীন বৃদ্ধ পিতা প্রতিবেশীগণের অনুগ্রহে দুর্ব্বহ জীবনভার বহনে ক্লান্ত হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাসে দাবানলের সৃষ্টি করত উৎকণ্ঠিত চিত্তে জীবন-নাটকের শেষ অভিনয়-দিনের অপেক্ষা করিতে লাগিল। কৈ ইহাতো সে চাহে নাই?
কৃপণ কালে ধনবান্ হইবার আশায় নানাবিধ অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করিয়া অতিথি-দেব-দ্বিজগণকে বঞ্চনা—এমন কি আপনাকে বঞ্চনা করিয়া নিজবক্ষ-রক্তের মতন সযতনে সঙ্গোপনে ধনরাশি স্তূপীকৃত করিল, একদিন ঘনঘটাচ্ছন্ন অন্ধকার নিশায় দস্যুগণ সঞ্চিত বিত্তের সহিত তাহার জীবন অপহরণ করিয়া লইল; প্রাতে ভয়বিহ্বল প্রতিবেশীমণ্ডলী দেখিল ছিন্নকণ্ঠে রক্তাক্ত কলেবরে ধনকুবের পড়িয়া আছে, আর তাহার লৌহসিন্ধুক তাহারই মাত্র ক্ষতবিক্ষত দেহে শূন্য প্রাণে কল্যকার ঘটনার সাক্ষ্য দিতেছে। কৈ কৃপণ তো ইহা চাহে নাই?
সুখ চাহিলেও পাওয়া যায় না, তাহার জন্য প্রাণপাত করি। কিন্তু দুঃখ না চাহিতে আইসে; তাহার জন্য কোন উদ্যোগ আয়োজন করিতে হয় না, তাহার আবাহন করিতে হয় না—সে আপনি আইসে। এস দুঃখ! তোমার জন্য প্রস্তুত আছি, সতৃষ্ণ নয়নে তোমার আশাপথ চাহিয়া বসিয়া আছি—এ কথা বলিয়া তাহাকে স্ফীতবক্ষে কেন আলিঙ্গন করিতে পারি না? কারণ— দুঃখটা অতি কষ্টের, অতি অশান্তির প্রকট মূর্ত্তি, সেইজন্য তাহার স্মরণেও শিহরিয়া উঠি। তাহার স্পর্শে শান্তিময় সংসার অশান্তির ভৈরব হুঙ্কারে বিভ্রষ্ট হইয়া পড়ে, নিষ্কলঙ্ক প্রাণ কালিমা-কলুষিত হইয়া যায়, সবল সুস্থ দেহ দুর্ব্বল ও রোগপ্রবণ হইয়া পড়ে পিককুলকূজিত নিকুঞ্জ পেচকের কর্কশ রবে পরিপূরিত হয়; সাধে বিষাদ, হাস্যে ক্রন্দন, শান্তিতে অশান্তি আসে বলিয়াই দুঃখের নামে বিশ্ববাসী চমকিত হইয়া উঠে। সত্যই ত’ শুষ্ককণ্ঠ ব্যক্তি পূততোয়া জাহ্নবীর পুণ্য বারিরাশির প্রার্থনা করিবে না তো কি করিবে? কৃষক উর্ব্বর ভূমিখণ্ড প্রার্থনা না করিয়া কি উত্তপ্ত বালুকাময় মরুভূমির জন্য ছুটিবে? ক্ষুধার্ত্ত—ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা না করিয়া কি নীরবে বসিয়া থাকিতে পারে? দরিদ্র—অর্থচেষ্টা না করিয়া কি করিবে? সুখস্পৃহা স্বাভাবিক, সকলেই সুখ চায়। কিসে সুখী হতে পারে তাহার চেষ্টা করিয়া থাকে। কিন্তু সকলে তাহা লাভ করিতে না পারিলেও তাহাই চাহিয়া থাকে। সুখের জন্য সকলেই লালায়িত। ঈশ্বরের পূজা ক’রে তাহার বিনিময়ে রূপ, যশ, ঐশ্বর্য্য, অক্ষয় স্বর্গবাস ইত্যাদি কামনা করে; দুঃখের ভয়ে সতত শঙ্কিত।
শ্রীওঙ্কার-রচনাবলি (১ম খণ্ড) থেকে