পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
একটু আগে তাঁকে দেখলাম। তিনি বললেন, ‘‘আমি এখন আবার কাজের মেজাজে ফিরে এসেছি।’’ স্বামী সারদানন্দকে অর্থসংগ্রহের জন্য বম্বে যেতে হবে। স্বামীজী নিজের মঠের কাজ চালিয়ে নেবেন। সকলকেই বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিছু ছেলেকে মাধুকরী করতে পাঠাবেন। কারণ তাদের ভরণপোষণের ভার নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। আমি দেখতে পাচ্ছি, স্বামীজীর মনে ভয়ানক সংগ্রাম চলছে। যোগানন্দের অসুস্থতা এবং তাঁর নিজের ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য বাড়তি খরচের বোঝা ঘাড়ে পড়েছে। যোগানন্দ স্বামীর জন্য প্রতিদিন প্রায় দশ টাকা খরচ হচ্ছে। স্বামীজী বলছেন, তিনি নিজে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর শিষ্যেরাও সেই অপরিসীম কৃচ্ছ্রতার মধ্য দিয়ে যাক, তা তিনি কখনওই চান না। মানুষ তৈরি করা তাঁর ব্রত। কিন্তু তাঁর ধারণা—খাওয়া-পরা ও একান্ত প্রয়োজনীয় অভাবগুলি মিটিয়ে দিলে কাজ আরও ভালোভাবে হবে। অপরিণত মনের পক্ষে অতিরিক্ত কঠোরতা ক্ষতিকারক। বুঝতে পারছি, তাঁর এইসব কথা কতখানি সত্য—কত ভয়ংকরভাবে সত্য। এর আগে সপ্তাহে দু’দিন করে মঠে পড়াতে যেতাম। এখন খরচ কমানোর জন্য সপ্তাহে একদিন যাচ্ছি।
ঘুরেফিরে ভারত ও ভারতের জনসাধারণের জন্য তিনি চিন্তা করেই যাচ্ছিলেন। তাঁর মন বিভিন্ন দিকে এত দ্রুত ধাবমান হচ্ছিল যে, আমি কদাচিৎ তাঁর চিন্তার সঙ্গে তাল রাখতে পারছিলাম। অন্নসংস্থানের জন্য নতুন কী উপায় করা যায়, কীভাবেই বা কলোনি গড়ে উঠবে, মানুষ তৈরি করার প্রারম্ভিক শর্ত হিসাবে কীভাবে খাদ্যের ব্যবস্থা করা হবে, ভারতের প্রাচীন শিল্পগুলির জন্য কী করে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার তৈরি করা যাবে, কেমন করে অর্থসংগ্রহ করে ব্যবসার গোপন কৌশলগুলি (ট্রেড সিক্রেট) আয়ত্ত করে ব্যাপকভাবে তার প্রয়োগ করা সম্ভব হবে—ইত্যাদি অনেক কথা বলে যাচ্ছিলেন।
‘আমি যেন স্বামীজী বা কারও জন্য উদ্বিগ্ন না হই’—তোমার এই মিষ্টি নির্দেশ কী করে পালন করি, বলো? আমি এখন বুঝতে পারছি যে, আমার ভারতে থাকাটাই অন্যদের ওপর বোঝার মতো। য়ুম তোমাকে সব কথা বলবে, আমার সামনে কী ভয়ানক ভবিষ্যৎ! কিন্তু কাজ থেকে সরে যাওয়া তো কাপুরুষতা। কথাটা স্বামী সারদানন্দের কাছে তুলেছিলাম। উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ, সেদিন স্বামীজী তোমার ইউরোপে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।’’ শুনে মনে হল, আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম, এদেশে আমার অনেক কাজ করার আছে। কিন্তু এখন আমি কিছুই জানি না। মনের মধ্যে সেই কথাগুলি উঠছে যা য়ুমকে বলেছিলাম। সেকথা মা-ই বলতে পারেন, ‘‘বৎস! আমাকে খুশি করার জন্য তোমার অনেক কিছু জানার দরকার নেই। শুধু আমাকে একান্ত আপনার জেনে ভালোবেসো।’’ টাকার প্রয়োজন, অন্য কোনও কারণে নয়— প্রয়োজন স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য। যদি সমস্ত জগৎ একসঙ্গে ব্যক্তিগত অধিকারবোধ ছাড়তে পারত, নিজের জন্য কিছুই না রাখতে চাইত, তাহলে আশ্চর্য এক নৈতিক বাতাবরণ মুহূর্তে সবকিছুকে বদলে দিত। যখন স্বামীজী আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন নারীকণ্ঠের একটানা সুতীব্র বিলাপধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। মেয়েটি রাস্তার উল্টোদিকে একটি কুঁড়েঘরে থাকে। আমি তার কাছে ছুটে গেলাম। জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘‘আমার গুরুদেব অসুস্থ। তোমার এই একটানা কান্না তাঁকে আরও কষ্ট দিচ্ছে।’’ সেই প্রৌঢ়া মহিলাটি একবার শুধু ‘মা মাগো’ বলে চুপ করে গেল। বহু বছর আগে তার যে ছেলেটি মারা গিয়েছিল, তারই জন্য এই বিলাপ। নিজের বলতে তার এইটুকু পরিচয় ছিল যে, সে একটি সন্তানের জননী।