গাড়ি শিল্পে ‘রক্তক্ষরণ’ অব্যাহত। নাগাড়ে গাড়ি বিক্রি কমছে। কোপ পড়ছে কাজে। গাড়ি শিল্পে ইতিমধ্যে ৩.৫ লক্ষ কাজ খুইয়েছে। এই অবস্থায় শিল্প মহলের হুঁশিয়ারি, অবস্থার উন্নতি না-হলে আরও কর্মী চাকরি হারাবেন। দেশে গাড়ি শিল্পের বৃদ্ধির ছবিটা প্রায় মুছে যাওয়ার মুখে। বাধ্য হয়ে উত্তর ভারতে মানেসর ও গুরুগ্রামের কারখানা দুটি দু’দিন বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে মারুতি-সুজুকি। দেশের যাত্রিবাহী গাড়ি বাজারের অর্ধেকই যাদের দখলে। বিক্রি কমায় সাত মাস ধরে তারা উৎপাদন ছাঁটাই করে চলেছে। আগস্টে তাদের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। টাটা মোটরস জামশেদপুরের বাণিজ্যিক গাড়ির কারখানাটি আগস্টে কিছু দিন বন্ধ রাখে। হন্ডা, মহিন্দ্রা অ্যান্ড মহিন্দ্রা, টয়োটা কির্লোস্কার মোটরস, হুন্ডাই, হিরো মোটো কর্প, টিভিএসের মতো অনেক সংস্থাই কয়েক দিন হয় সম্পূর্ণ, না-হয় আংশিক উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। গাড়ি শিল্পে এই মন্দার বিরূপ প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়ছে যন্ত্রাংশ শিল্পেও। মনে রাখবেন, উৎপাদনমুখী শিল্পে গাড়ি শিল্পের অংশীদারি ৪৯ শতাংশ। মোট কর্মসংস্থানের ৮ শতাংশের উৎস এই শিল্প। শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে গত ১৫ মাসের হিসেব অনুযায়ী ধীরতম বৃদ্ধি ঘটেছে গত আগস্ট মাসেই। গত ত্রৈমাসিকে বার্ষিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ, যা গত গত ৬ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে ধীরতম। এসবের জেরে টান পড়েছে ইস্পাতের চাহিদাতেও। টাটা স্টিলের শীর্ষ কর্তা সম্প্রতি তাঁদের বিভিন্ন প্রকল্পে লগ্নি ছাঁটাই ও বিদেশে কিছু শাখা সংস্থা বন্ধের কথা বলেছেন। একইসঙ্গে মার খাচ্ছে ফ্ল্যাট-বাড়ির বিক্রিবাটাও। আর এই ঝিমিয়ে থাকা চাহিদার ধাক্কা এসে পড়েছে রং শিল্পের গায়ে। হিসেব বলছে, গাড়ি শিল্পে রঙের চাহিদা কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। বিক্রি ফিকে হয়েছে আবাসনের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রেও। রং সংস্থাগুলির আশঙ্কা, অর্থনীতির শ্লথ গতি বহাল থাকলে সার্বিকভাবে চাহিদা আরও কমতে পারে। ফলে, এই মুহূর্তে ব্যবসা হারানোর ভয়ে কার্যত কাঁটা তারা। চাহিদায় ভাটার টান তো চলছিলই, সেইসঙ্গে সঞ্চয়েও মন্দা প্রকট হচ্ছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতির ঝিমিয়ে পড়ার কারণ খুঁজতে অর্থ মন্ত্রকে আলোচনা চলছে। সরকারি সূত্রের খবর, সেখানেও ঝিমুনির অন্যতম কারণ হিসেবে সঞ্চয়ের হার কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে আসছে। নতুন লগ্নি ও রপ্তানি—দু’দিকেই ভাটার টান। সরকারি খরচ বিশেষ বাড়ছে না। বাজারে কেনাকাটাই ছিল ভরসা। এবার তাও কমে গিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটা সময় লোকে টাকা জমিয়ে তবে দামি জিনিসপত্র কিনত। তারপর সহজে ঋণ মিলতে শুরু করল। ফলে, বাড়ল ধার করে জিনিস কেনার প্রবণতা। টাকা শোধ হত ইএমআই-তে। ইদানীং আয় তেমন বাড়ছে না। ভবিষ্যতে বাড়বে কি না তাও অনিশ্চিত। ফলে ধারে কেনার প্রবণতা কমেছে। ও-দিকে পুরনো ধার মেটাতে আয়ের অনেকখানি খরচ হয়ে যাচ্ছে বলে সঞ্চয়ও কমছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য যে খারাপ হচ্ছে, তা তুলে ধরছে বিভিন্ন পরিসংখ্যান। আর যত তা স্পষ্ট হচ্ছে, ততই যেন ভোঁতা হচ্ছে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্র ঘোষিত পদক্ষেপগুলির ধার।
এদিকে সর্বকালীন রেকর্ড গড়ল সোনার দাম। জিএসটি যোগ করে রাজ্যে প্রতি ১০ গ্রাম ২৪ ক্যারাট পাকা সোনা ছাড়িয়েছে ৪০ হাজার টাকা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর কারণ একদিকে, বিশ্ব বাজারে সোনার দাম বাড়ায় আমদানির খরচ বৃদ্ধি। অন্যদিকে, দেশে আমদানি শুল্ক ও জিএসটির চড়া হার। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, আগামী দিনে আমদানি আরও কমলে হলুদ ধাতু আরও দামি হতে পারে। সোনার দাম এতটা বাড়ায় মাথায় হাত গয়নার কারিগরদেরও। গয়নার চাহিদা কমেছে। এতটাই যে, তাঁদের বরাত প্রায় তলানিতে। কারিগরদের বাঁধা মাইনে নেই। প্রতিটি গয়না তৈরির জন্য মজুরি পান তাঁরা। ফলে কোপ পড়ছে অনেকের রুটি-রুজিতে। কোথায় যাবে দেশের আম জনতা? উত্তর নেই। অর্থনীতির আকাশে মন্দা ঘনাচ্ছে বলে তোপ দাগছেন বিরোধীরা। তবু সঙ্কটের কথা কবুল করেনি সরকার। তবে দফায় দফায় গাড়ি, ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন শিল্পকে চাঙ্গার পদক্ষেপ করে অর্থমন্ত্রী বুঝিয়ে দিচ্ছেন অবস্থা বেগতিক। আশ্বাস দিচ্ছেন সব সমস্যা সমাধানেরও। বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুধু ভারত নয়, পুরো বিশ্বই ভুগছে আর্থিক অনটনে। ঘরে চাহিদার অভাব, বাইরে চীন-মার্কিন শুল্ক যুদ্ধ। ভারত ছাড়া, অন্যান্য দেশেও উৎপাদন শিল্পের গতি শ্লথ হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে বিভিন্ন সমীক্ষায়। ব্রেক্সিট নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিশ্ব অর্থনীতির গতি শ্লথ হওয়ায় গত সাত বছরে উৎপাদন শিল্প সবচেয়ে দ্রুত হারে সঙ্কোচনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ব্রিটেনে। উৎপাদন সরাসরি কমার ইঙ্গিত জার্মানিতে। বাণিজ্য-যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উৎপাদন শিল্পেও। অন্য একটি সমীক্ষা বলেছে, চীনে কারখানায় উৎপাদন কমার কথাও। তাহলে কি ফের বিশ্বমন্দার থাবায় গোটা দুনিয়া? আশঙ্কা বাড়ছেই।