বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
এই প্রশ্ন বৃহস্পতি-শুক্রবারের জন্মাষ্টমীর চড়া ফুলবাজার দেখেই উঠে পড়ল এমন ভাবলে ভুল হবে। নিশ্চয়ই সেটা একটা কারণ। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, প্রতি বছর ঠিক এই সময়, মানে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর মুখে নানা অছিলায় কেবল ফুল-বেলপাতা নয়, শাক-সব্জি, ফলমূল থেকে যাবতীয় জিনিসপত্রের দাম ধকধক করে বেড়ে যায়! শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছর শুনছি দুর্গাপুজোর অব্যবহিত পরে লক্ষ্মীপুজোর আগে বাজার থেকে তাজা শাক-সব্জি, ফলমূল সব নাকি হাওয়া হয়ে যায়! তার জায়গা নেয় নিকৃষ্টমানের জিনিসপত্তর। পুজোর তাগিদে আগুন দামে সেই অতি নিকৃষ্ট মানের শাক-সব্জি ফলমূল কিনতে বাধ্য হন মানুষ! কেন এমন হয়? এর পিছনেও নাকি ফড়ে-পাইকার-মজুদদারদের কারসাজি! ওরা জানে, পুজোর মরশুমে চাহিদা থাকে তুঙ্গে। বাজারে পুজোর কাঁচা আনাজ ফলমূলের মতো সরঞ্জাম বিকোতে সময় যাবে না। ভালো মনোমতো না পেলেও লোকে পুজোর সামগ্রী কিনবেন। অন্য সময় মনের মতো জিনিস না পেলে যে মানুষটি না কিনে চলে যেতে পারেন পুজোর সময় পারবেন না। তাই, ভালো মালটা স্টোরে রেখে সেখানে জমানো যাবতীয় হাবিজাবি বাজারে চালান করে দেয় ওই মুনাফাবাজেরা, সঙ্গে লাগায় চড়া দাম। লাভ দু’দিকে—চড়া দামে চড়া মুনাফা সঙ্গে যে জিনিস রোজকার বাজারে বিকোনো মুশকিল হতো তা বিকিয়ে গেল অনায়াসে! কী মজা বলুন! অন্যদিকে, আর একটা যুক্তিও আছে—বৃষ্টি। আমাদের জাতীয় উৎসব দুর্গাপুজো আসে বর্ষার অব্যবহিত পর শরতের নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে। কিন্তু বিশ্বজোড়া উষ্ণায়ন ও দূষণবিষে নাজেহাল প্রকৃতির ছন্দে এখন অনেক সময়ই তাল ঠিক থাকছে না। ফলে, বিলম্বিত বর্ষা ঢুকে পড়ছে শরতের আঙিনায়। শরতের নির্মেঘ আকাশেও জমা হচ্ছে ঘন কালো বজ্রবিদ্যুৎ ভরা মেঘ আর তার অঝোর বর্ষণে বানবন্যার মতো সমস্যা অব্দি ঘনাচ্ছে! তাতে ফসলেরও যে কিছু ক্ষতি হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। এবার এই ভরা ভাদ্রে তেমনই দেখা যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারও কলকাতা মহানগরী সমেত রাজ্যের বেশ কিছু অঞ্চলে জোর বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু, এবার দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা অনেক দেরিতে ঢুকেছে। আষাঢ়, শ্রাবণের বেশির ভাগটাই ছিল মোটের ওপর শুখা। উত্তরবঙ্গে অবশ্য তখন বৃষ্টি হয়েছে নাগাড়ে। অসম, ত্রিপুরার মতো পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে তো রীতিমতো বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কোথাও কোথাও বন্যাও হয়ে গেছে! কিন্তু আমাদের কলকাতায় বৃষ্টি ছিল ছিটে-ফোঁটা! তখন শুনেছি, বাজারে বলা হচ্ছিল, এবার পুজোয় শাক-সব্জি, ফলমূল কিস্যু মিলবে না। মিললেও যা দাম হবে...! কেন? কেন কী? দেখছেন না কী ভয়ঙ্কর রোদ। বৃষ্টির ছিটে-ফোঁটা নেই! মাঠ তো ফুটিফাটা, জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেছে ধান-সব্জি-ফল-ফলারির চাষ। বাজারে আসবে কী, আসবে কোত্থেকে?
সত্যি, কথাটায় যুক্তি আছে। সেই যুক্তির খোঁচায় আম বাঙালির মনে সেই সময় থেকেই এবারের লক্ষ্মীপুজো, ভাইফোঁটা নিয়ে খুচখুচ চিন্তার প্রবেশ। ভাইফোঁটা কারণ, বৃষ্টিবিহীন দিনের মাছ বাজারেও তখন ভাটির টান। ভালো মাছ নেই। আষাঢ় শ্রাবণ চলে যাচ্ছে ইলিশ দূরস্থান, সামান্য রুই কাতলাও নেই তেমন! যা আছে ছোট-বড় সবই ফর্মালিনে চোবানো সাদাটে সাতবাসি। আর দাম সে তো চড়েই আছে। কী হবে? হল। শেষ অব্দি শ্রাবণের একেবারে শেষে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এল দক্ষিণবঙ্গে। কলকাতার সুখ্যাত জায়গাগুলোতে জলও জমল। কখনও জোড়া, কখনও একক নিম্নচাপের জেরে, তারপর থেকে গত বৃহস্পতিবার অব্দি বৃষ্টির রেশ চলল ভালোই। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাসে তারপরও বৃষ্টি আছে। হচ্ছে এবং হবে। অনেকে বলছেন, এই বৃষ্টি এবার পুজো না দেখে যাবে না। অন্যদিকে, পুবালি বাতাস উঠতে ইলিশও এল বাজারে। সব মিলিয়ে ভাদ্রের শুরুতে খিচুড়ি, ইলিশে বর্ষার মৌজ বেশ ভালো মতোই ঢুকে পড়ল বাঙালির হেঁশেলে। আমরা ভাবলাম— যাক বাবা, বাঁচা গেল। শুখার হাত থেকে রেহাই। পুজোতে এবার অন্তত তরতাজা শাক-সব্জি, ফলমূল, মাছ সব মিলবে। দাম একটু হয়তো বেশি হবে, হোক। সে আমাদের গা-সওয়া। একেবারেই না মেলা বা পচাধচা মেলার চেয়ে সে ঢের ভালো। কিন্তু, সেখানেও গেরো! অসময়ের বৃষ্টি! আর তাতেই নাকি সাড়ে সর্বনাশ হচ্ছে ফল-ফসলের এবং তার জেরে পুজোর বাজারে তার টানাটানি পড়ার ঘোর সম্ভাবনা। বোঝো কাণ্ড! বৃষ্টি না হলে বিপদ, বৃষ্টি হলেও বিপদ! তাহলে আমরা যাই কোথায়? প্রকৃতিদেবীই বা কী করেন? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে আধুনিক চাষবাস, সেচ প্রযুক্তি—কিছুই কিছু না। সময়ে বৃষ্টি, শুধু সময়ে হলেই হবে না মাপমাত্রা বজায় রেখে বৃষ্টি (আজকের এই দূষণ-জর্জর পৃথিবীতে যা ক্রমশ দুর্লভ হচ্ছে) না হলে পুজো উৎসবের দিনে এমন ভোগান্তি চলতেই থাকবে? উত্তরটা এখনও মেলেনি।
এর মধ্যেই সঙ্কট ঘনীভূত করতে ঢুকে পড়েছিল মাল পরিবহণে ধর্মঘট। এটাও অনেকটা যেন ট্র্যাডিশনের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুজোর আগ দিয়ে ভাড়া বাড়ানোই হোক কি ড্রাইভার কর্মীদের নিরাপত্তা কোনও একটা অজুহাতে ধর্মঘট ডাকাটা বহুদিন যাবৎই দেখা যাচ্ছে একটা রেওয়াজের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ধর্মঘট হলে সেই অছিলায় রাতারাতি বাজারে যাবতীয় জিনিসপত্রের দাম চড়ে যায়, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন জোগানেও টান পড়ে—আর সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস ওঠে বাংলার সাধারণ মানুষের ঘরে। দামের আগুন, ঘর-গেরস্তালির পুজো-পার্বণের জিনিসপত্র পাওয়া নিয়ে চিন্তা, দুশ্চিন্তা এবং তার সঙ্গে ঘরে-বাইরে নানান টানাপোড়েন—বাঙালির সংবৎসরের উৎসবের আয়োজন উদ্যোগ আনন্দকে হাজার একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। সে পাড়ার পূজার উদ্যোক্তাই হোন (কর্পোরেট মার্কা ঢাউস পুজোর কথা বলছি না) কি নগর মহানগর গ্রাম-গ্রামান্তের গরিব মধ্যবিত্তজন—চিন্তার ভাঁজ পড়ে সকলের কপালেই। এত এত বছরেও এই চিন্তার হাত থেকে মুক্তি মিলল না বাঙালির! পুজো আসছে, বাজার চড়বে: এই ট্র্যাডিশন চলেই চলেছে। এবার তো আবার অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ থেকে দেশে আর্থিক মন্দার পূর্বাভাস মিলছে। মোদিজি বা তাঁর সরকার তা স্বীকার না করলেও একটা কাঁটা খচখচ করবেই দেশজনতার মনে।
তা সত্ত্বেও মহামায়া মা দুর্গা, মা লক্ষ্মী, কি মা কালী, মা জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক আরাধনায়, তাঁদের নিয়ে আনন্দযজ্ঞের আয়োজনে বাঙালি এবারও নিশ্চিতভাবেই মাতোয়ারা হবে। কারণ একটাই, বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত ভক্তিপ্রাণ উৎসব প্রিয় আবেগ। এই আবেগের উচ্ছ্বাসেই প্রতিবছর ঝড়-জল-বৃষ্টি-বন্যা-খরা থেকে আর্থিক মন্দা, বাজারে দামের চোখরাঙানির মতো যাবতীয় প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেও বাঙালি শারদোৎসবের আয়োজনে অবিচল এককাট্টা থেকেছে—এমনকী, এই হাইটেক মোবাইল বন্দি যুগেও! এটা কম বড় কথা নয়। এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না এটা হলফ করে এখুনি বলে দেওয়া যায়। কিন্তু, আগুনে বাজার—তা কী হবে!
উৎসবের আনন্দ-পথে সবচেয়ে বড় কাঁটাটা তো সেখানেই—তাই না?