একটির পর একটি। তারপর আরও একটি। নারী নির্যাতনের যেন বিরাম নেই। একেকবার এক-একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয় দেশ। কিছুদিন তর্ক-বিতর্ক চলে, রাজনৈতিক বেনিয়ারা মুনাফা তোলার চেষ্টা করে—তারপর আবার যে কে সেই। আবার কিছুদিন পর অন্ধকারের জীবদের লোলুপ লালসার শিকার হয় দেশের কোনও না কোনও প্রান্তের কোনও নাবালিকা, কিশোরী অথবা গৃহবধূ। এ তো একটা উদাহরণ মাত্র। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বলা ভালো, হতে বাধ্য হচ্ছে। তা সে নিরক্ষর গৃহবধূই হোক বা উচ্চ শিক্ষিতা চাকরিজীবী। শুধু নির্যাতন বা বৈষম্যের রকমফের রয়েছে। আসলে নারী স্বাধীনতা বলতে যেটা বোঝায়, সেটা আমাদের মতো দেশে হচ্ছে লাটাই ও ঘুড়ির সম্পর্কের মতো। শেষমেশ পুরুষতন্ত্রের উপরেই থাকে নারী স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সুতোটি। সেই কারণে আমরা নির্ভয়া, কাঠুয়া, পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি বা উন্নাওয়ের ঘটনায় সাময়িক উত্তেজনাবোধ করলেও আমাদের মাথার মধ্যে এখনও প্রকৃত ‘বোধ’ হয়তো কাজ করেনি। এর মূলে যে শুধুমাত্র অশিক্ষা রয়েছে তা নয়, ‘বীরভোগ্যা ধরিত্রী’র মতোই রমণীকেও ভোগ্যবস্তু বা প্রাত্যহিক পণ্যসামগ্রী হিসেবে প্রতিপণ্য করার কাজ একেবারে শিকড় গেড়ে রয়ে গিয়েছে। আইন, বলপ্রয়োগ, কঠোরতম শাস্তি— এই অসুখের ওষুধ নয়। নারী সম্পর্কে মানসিক ব্যাধিকে রোগমুক্ত করাই প্রধান কাজ।
যেমন উন্নাও ধর্ষণকাণ্ডে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের মুখ পুড়েছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু, এটাই কি শান্তি ও স্বস্তির বিষয় হতে পারে গেরুয়া-বিরোধী শিবিরের! কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে দলের লেবেল এঁটে একটি শিশিতে ভরে ফেললে কি সেই কাজটা খাটো হয়ে আসে না! সে তো গোটা সমাজের, সমগ্র দেশের ধিক্কার-ঘৃণার পাত্র!
এরই মধ্যে ঘরে-বাইরের চাপে ধর্ষণকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেনগারের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিজেপিও তাকে তাড়িয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই ধর্ষণ মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত শশী সিংয়ের ছেলে নবীন সিং, প্রধান অভিযুক্ত কুলদীপ সিং সেনগারের ভাই এবং কুন্নু মিশ্র নির্যাতিতাদের বাড়ি এসে শাসিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ যা সংবাদ সূত্রে জানা গিয়েছে।
এতো গেল, অভিযোগ লিপিবদ্ধ হওয়া ধর্ষণের কথা। রোজ ট্রামে, বাসে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজে এমনকী পরিবারের অন্দরেও কত না ভাবে অপমানের, লাঞ্ছনার সহজলভ্য শিকার হন মেয়েরা। কোথাও লোকলজ্জার ভয়ে, কোথাও আর্থিক অনগ্রসরতার কারণে, কোথাও নিম্নবর্ণের কারণে, কোথাও পারিবারিক সম্মান নষ্টের ওজরে তাঁদের মুখ বন্ধ রাখতে হয় প্রতিনিয়ত। হয়তো সবগুলি ক্ষেত্রই ধর্ষণের মতো বিষয় নয়। কিন্তু, তাঁদের ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে এই ধরনের অপমান মেনে নিতে বাধ্য হন তাঁরা। সেটাও আমাদের দেশের মতো পুরুষবলতন্ত্রের কারণে।
সুতরাং, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে—অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর বিধানে শাস্তি পেতে হচ্ছে বা ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে— এতেও কি আগামী দিনে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন রোধ করা সম্ভব? শাস্তি যতই কঠোর হোক, তাতে ‘মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত’ অপরাধীকে তার প্রবণতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা অসম্ভব? শিউরে ওঠা শাস্তির নিদর্শনও তাদের কাছে তুচ্ছ। ফলে, এই ব্যাধিকে সমাজ থেকে নির্বাসিত করার একটাই অস্ত্র— প্রকৃত শিক্ষা। সেটা শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা নয়, সামাজিক ভিতের তলা থেকে শিক্ষিত করে তোলার কাজ করতে হবে। যা শুধুমাত্র কোনও আইনের, দলের বা সরকারের কাজ নয়, সমাজের-পরিবারের আঁতুড়ঘর থেকে সেই মানসিক শুদ্ধিকরণের কাজটা জরুরি।