লোকসভা ভোটের আগে ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০১৮ সাল। কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও মিজোরামে বিধানসভার ভোট ছিল। ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করার পর থেকে রাজ্যে রাজ্যে বেরিয়ে পড়েছিল বিজেপির বিজয়রথ। নয় নয় করে এককভাবে অথবা প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ জোট করে ১৯টি রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিল দলটি, বিজেপির ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব। কিন্তু, অচিরেই মোদিজির দল হোঁচট খায় ২০১৮-তে পৌঁছে। একের পর এক উপনির্বাচনে গ্রাফ নামতে থাকে। বিরোধীরা, বিশেষ করে রাহুল গান্ধীর দল কংগ্রেস হঠাৎ করে যেন অক্সিজেন পেয়ে যায়। বিজেপির প্রতি মানুষের একটি বড় অংশের এই বিরূপ মনোভাবের পিছনে ছিল জীবন জীবিকার অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি। ভারত এক বৃহৎ কৃষিপ্রধান দেশ। ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। হয় তারা নিজের জমিতে অথবা অন্যের জমি ভাগে নিয়ে ফসল ফলায় কিংবা খেতমজুর। এরপর এক শ্রেণীর মানুষ আছে কৃষিপণ্য বিক্রয় এবং কৃষিজ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মোদির প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠার পর জনসংখ্যার এই যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাদের ইতিবাচক কোনও পরিবর্তন হয়নি। ফসলের ন্যায্য দাম পায়নি কৃষক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ফসল নষ্ট হওয়ার পর ক্ষতিপূরণ পায়নি বিমা না-থাকায়। ঋণভাবে জর্জরিত হয়েছে অনেকে। বাধ্য হয়েছে কিছু চাষি আত্মীঘাতী হতে। কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কংগ্রেস আমলেও ছিল। কিন্তু, মোদি জমানায় এসে তাতে লাগাম তো পড়েইনি উল্টে গতি বেড়েছিল। বৃদ্ধ অথবা অন্যভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলা চাষিদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ, কারণ তাঁদের তেমন সঞ্চয় পেনশন ভাতা প্রভৃতি কোনোকিছুরই সংস্থান নেই। তীব্র অসন্তোষ ছিল কৃষিশ্রমিকদের যৎসামান্য মজুরি নিয়েও। অসন্তোষ বেড়েছিল দ্রুত। প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল দিল্লিতে মসনদের দোরগোড়ায়। ২০১৮-র বিধানসভা ভোটের ময়দান সরগরম হয়ে উঠেছিল কৃষকের কান্না নিয়ে। কৃষকের চোখের জলের দাম মেটাতে হয়েছিল নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহদের।
মাস কয়েকের ব্যবধানে লোকসভার ভোটে বিজেপি-কংগ্রেস দ্বৈরথ জমে উঠেছিল কৃষকদের সুরাহা দেওয়ার প্রতিযোগিতায়। বলা বাহুল্য, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদির কৃষকপ্রীতি রাহুল গান্ধীর কৃষকপ্রীতির অধিক বিশ্বাসযোগ্য বলে দেশ মনে করেছে। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হয়েই মোদির সরকার কৃষকদের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে—ধানসহ অনেকগুলি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। ওইসঙ্গে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দিতেও পদক্ষেপ করেছে সরকার। বুধবার এই মর্মে বিল পেশ করা হয়েছে সংসদে। সরকারের এই তৎপর উদ্যোগটি প্রশংসার দাবি রাখে। বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিরক্ষার সূচনা হিসেবেও দেখা যেতে পারে এটাকে। প্রতিটি ভোট রাজনৈতিক দলগুলির কাছে একটি শীতকালের মতো। একটা মাঘ কোনোক্রমে পার করে দিতে পারলেই স্বস্তি মেলে না। যেমন এবছরের শেষের দিকে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্য বিধানসভার ভোট। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে আগামী বছর ভোট নেওয়ার কথা বিহারে। আমরা জানি, এই রাজ্যগুলির কৃষিনির্ভরতা কতখানি।
লোকসভার সাফল্য ধরে রাখার জন্যও মোদি সরকারকে কৃষককল্যাণে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হচ্ছে। সেটা ভালো। তবে, এই প্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে যে এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। কারণ বীজ সার কীটনাশক ডিজেল বিদ্যুৎ এবং অন্যসকল কৃষিউপকরণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। অধিকাংশ কৃষক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কঋণের সুবিধা পায় না। মহাজনী সুদ গুনতে গুনতেই তারা ফতুর হয়ে যাচ্ছে। তার উপর একদিকে বৃষ্টির অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে বন্যা ঝড় শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কোপ থেকেও রক্ষা পাওয়ার উপায় সব কৃষকের নাগালে নেই। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেঁধে দেওয়ার সময় এই কথাগুলি আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। তা নাহলে কৃষককল্যাণ গালভরা স্লোগানের অতিরিক্ত হয়ে উঠবে না। আটকানো যাবে না কৃষকের আত্মহত্যার মিছিল। কৃষির সঙ্কট অন্যসকল জীবিকার উপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ বেকারত্বের যে কলঙ্ক দেশ এখন বইছে তা থেকে মুক্তির স্বপ্নও অধরা রয়ে যাবে।