নর্থ ব্লকের দোতলার এক কোণে অর্থমন্ত্রীর টেবিলে তিনি বৈঠকে বসেছেন আগেও। তখন তিনি অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির প্রতিমন্ত্রী। এখন সেই অরুণ জেটলির ছেড়ে যাওয়া চেয়ারেই বসেই প্রথম পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নির্মলা সীতারামন। ৫ জুলাই বাজেট পেশ করবেন তিনি। সেখানে রাজকোষ ঘাটতি লাগামের মধ্যে রেখে বেসরকারি লগ্নিতে জোয়ার আনতে দাওয়াই দেওয়াই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে তাঁর সামনে। কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতির বৃদ্ধিতে গতি আনতে তাঁর প্রথম বাজেটে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের উপর জোর দিতে পারেন দেশে এই প্রথম পুরো সময়ের মহিলা অর্থমন্ত্রী। ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তবর্তী বাজেটেও পীয়ূষ গোয়েল পরিকাঠামো ক্ষেত্রের জন্য রেকর্ড ৮৩,০১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। ২০১৪ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে মোদি সরকার এই ক্ষেত্রের জন্য ৩৪,৩৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। তারপর থেকে প্রতিবছর পরিকাঠামো ক্ষেত্রের জন্য বাজেট বরাদ্দ এবং লগ্নি বেড়েই গিয়েছে মোদি সরকারের প্রথম জমানায়। এবারও সেই পথেই হাঁটতে পারেন নির্মলা। বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারেও দেশের পরিকাঠামো ক্ষেত্রে পাঁচ বছরে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সীতারমানের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, দেশের কৃষিক্ষেত্রে দুর্দশার মোকাবিলা করা এবং কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির বৃদ্ধির গতি বাড়ানো। কিন্তু এই বিপুল অর্থ আসবে কোথা থেকে? অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ওই বিশাল পরিমাণ লগ্নির অর্থ জোগাড় করতে  ‘ট্যাক্স-ফ্রি ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড’  নতুন করে ফিরিয়ে আনতে পারেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। ২০১০ সালে আয়কর আইনের ৮০সিসিএফ ধারায় সরকার অনুমোদিত ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ডে বছরে ২০,০০০ টাকা অবধি লগ্নির উপর করছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু,  ২০১৩-১৪ অ্যাসেসমেন্ট বছর থেকে ওই সুবিধা তুলে দেওয়া হয়। নতুন করে এই ট্যাক্স-ফ্রি ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড ফিরিয়ে আনা হলে সাধারণ ছোট লগ্নিকারীরা যেমন আকৃষ্ট হবেন,  তেমনি পরিকাঠামো ক্ষেত্রে লগ্নির জন্য ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি,  রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন কর্পোরেশন,  এনটিপিসি,  ভারতীয় রেল,  হাউজিং অ্যান্ড আর্বান ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন,  পাওয়ার ফিনান্স কর্পোরেশন প্রভৃতি বহু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাজারে ওই বন্ড বা ঋণপত্র বিক্রি করে সহজে মূলধন জোগাড় করতে পারবে। বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে তাঁর প্রথম বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণের এক নয়া দিশা দিতে পারেন সীতারামন। এরই পাশাপাশি,  মোদি সরকারের দ্বিতীয় জমানায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিকরণের পথনির্দেশিকাও থাকতে পারে সীতারামনের বাজেট প্রস্তাবে।
প্রথমবারের থেকেও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরলেও মোদি সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির বৃদ্ধির হারকে টেনে তোলা এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। নির্মলার দায়িত্ব নেওয়ার দিনেই প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে,  বৃদ্ধির হার গত ৫ বছরে সর্বনিম্ন। একইভাবে বেকারির হারও যে মাথা ব্যথার কারণ,  তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ৪৫ বছরের রেকর্ড উচ্চতায় বেকারত্বের হার এবং পাঁচ বছরের তলানিতে পৌঁছনো দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার,  কৃষি দুর্দশা, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় অনাদায়ী ঋণের সমস্যা,  এবং সর্বোপরি নন-ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্কটের দুর্যোগ থেকে দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত বের করে আনা যে তাঁর পক্ষে মোটেই সহজ কাজ নয় একথা নির্মলা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন। তাই বাজেট তৈরির আগে যতটা পারা যায় সাধারণ জনগণ,  অর্থনীতিবিদ,  শিল্পমহলের মন বুঝে নিতে চাইছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের অর্থনীতির দাপুটে ছাত্রী। সিআইআই এবং অ্যাসোচ্যামের মতো দেশের প্রথম সারির বণিকসভাগুলি কর্পোরেট সংস্থাগুলির জন্য আয়কর কমানো এবং সরলীকরণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আয়কর ছাড়ের সীমা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। ব্যক্তিগত আয়করে ছাড়ের সীমা বাড়ানোর পক্ষে প্রধান যুক্তি হল,  সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজের হাতে খরচ করার মতো আয়ের পরিমাণ বাড়লে অর্থনীতিতে ভোগব্যয় বাড়বে,  যা এই মুহূর্তে প্রায় উবে গিয়েছে। গাড়ি-বাড়ির বাজারের মন্দাভাব টিভি-ফ্রিজ প্রভৃতি ভোগ্যপণ্যের বাজারেও লেগেছে। অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়াতে ফেব্রুয়ারি থেকে পর পর তিনবার সুদের হার কমিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। কিন্তু,  তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। ফলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নির্মলা সীতারামনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে,  অর্থনীতির অধোগতি সামলানো। নিজের স্বকীয়তার ছাপ রেখে নির্মলা কতটা সংস্কারমুখী বাজেট পেশ করবেন তা নিয়ে দেশের আমজনতা এখন তাকিয়ে ৫ জুলাইয়ের দিকে।