শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। ঋণগ্রহণ এবং ঋণদান বা অর্থলগ্নি বাণিজ্যের একটি বড় দিক। সব ধরনের বাণিজ্যিক সংস্থাকেই ঋণ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগতে হয়। সরকারি/বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও অর্থলগ্নি সংস্থা এবং সরকারি/বেসরকারি তহবিল কোনও সংস্থাকে ঋণ দেওয়ার আগে বা সেখানে অর্থ বিনিয়োগ করার আগে তার ঋণগ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি যাচাই করে নেয়। অর্থাৎ দেখে নেওয়া হয় ঋণ দেওয়ার বা বিনিয়োগ করার বা সঞ্চয় করার পর শর্তমাফিক অর্থ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি কতখানি থাকবে অথবা থাকবে না। এটিকেই ক্রেডিট রেটিং বলা হয়। ক্রেডিট রেটিং করার জন্য মান্য সংস্থা (ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি বা সিআরএ) আছে। তারাই বিভিন্ন শিল্প বাণিজ্য সংস্থার ঋণগ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে ক্রেডিট রেটিং দিয়ে থাকে। এই রেটিং করা হয়ে থাকে শিল্প বাণিজ্য সংস্থার ব্যবস্থাপনা, স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সচ্ছলতা পর্যালোচনা করার ভিত্তিতে। একই নিয়মে অবশ্য ঋণগ্রহণেচ্ছু সাধারণ ব্যক্তি এবং সরকারেরও ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে। যেমন—এএএ, এএ, এ, বিবিবি, বিবি, বি, সি, ডি প্রভৃতি। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকারের ক্রেডিট রেটিং পরিবর্তনশীল। স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে তাদের পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে ক্রেডিট রেটিং উন্নত বা অবনত হতে পারে। উন্নয়নে আন্তরিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সরকার তাদের ক্রেডিট রেটিং উঁচু রাখার দিকে যত্নবান হয়। কারও ক্রেডিট রেটিং ধারাবাহিকভাবে উঁচু থাকলে তার সম্পর্কে বাজার অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকে। আর যার ক্রেডিট রেটিং ধারাবাহিকভাবে নিচু বাজার তার সম্পর্কে স্বভাবতই শঙ্কিত থাকে। সোজা কথায়—কোনও প্রতিষ্ঠানে (এবং, ব্যক্তিকেও) ঋণদান, বিনিয়োগ বা সঞ্চয় করার আগে যে-কোনও সুস্থ বুদ্ধির মানুষ বা প্রতিষ্ঠান তার ক্রেডিট রেটিং বাস্তবে কেমন তা মাথায় রাখে। ক্রেডিট রেটিংয়ের তিনটি সংস্থা খুব বড়। তারাই মোট প্রয়োজনের ৯৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
ক্রেডিট রেটিং এতকাল মূলত শিল্প বাণিজ্য মহলের চর্চার বিষয় ছিল। এবার সেটা দেশের সাধারণ গৃহস্থকেও ভাবিয়ে তুলেছে। একজন সাধারণ নাগরিক চাকরি করেন। মাস মাহিনায় তাঁর দৈনিক সংসার চলে আর শখ আহ্লাদ মেটে। অবসরপরবর্তী জীবন নিয়েও তাঁকে বিশেষ ভাবতে হয় না। কারণ, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট হিসেবে তাঁর জন্য সরকারের ঘরে সঞ্চিত থাকে পিএফ এবং পেনশন তহবিল। ওই টাকা নিয়ে সরকারি চাকুরে পরিবারগুলি একশোয় হাজারভাগ নিশ্চিন্ত থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চিঠি মারফত দেশবাসী জানতে পারছেন যে, এবার সরকারি চাকরিজীবীদের এই ধরনের টাকাও আর পূর্ণ সুরক্ষিত নয়। অনেকগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীদের পিএফ এবং পেনশনের টাকা কেন্দ্রের তরফে একটি কোম্পানিতে লগ্নি করা হয়েছে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএস) নামে ওই সংস্থাটি আজ ঋণভারে জর্জরিত। তাদের ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার কোটি টাকা! কেন্দ্রীয় সরকার কার পরামর্শে এমন একটি ভয়ংকর পদক্ষেপ করতে পারল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা জানতে চেয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুনে আইএলএফএসের ক্রেডিট রেটিং ছিল এএএ। অর্থাৎ খুব উঁচু। মাত্র তিন মাস বাদে, সেপ্টেম্বরে ওই রেটিং অনেক নেমে গিয়েছে! প্রতিষ্ঠানটির ক্ষেত্রে কী এমন ঘটল যে এতখানি বিপর্যয়ের সংকেত দেওয়া হল? সংগত প্রশ্নই তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নোটবন্দি এবং জিএসটির ধাক্কায় দেশবাসীর যখন নাভিশ্বাস ছুটছে ঠিক তখনই এই ঘটনা—চাকরিজীবীরা সত্যিই উদ্বিগ্ন। মুখ্যমন্ত্রী নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে অর্থ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী পন রাধাকৃষ্ণণ মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন যে বিষয়টি সেবি এবং আরবিআই গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখছে। অন্যদিকে, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক আরও জানিয়েছে, এ নিয়ে তদন্তে নেমেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা এসএফআইও। এসএফআইও-র রিপোর্টের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ করবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সংশ্লিষ্ট ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির যোগ্যতা এবং তাদের কোনও মতলব ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার। এরপর এই ধরনের রেটিংয়ের মান এবং প্রয়োজনটাই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। শুধু
কয়েক লক্ষ সরকারি কর্মীকে নয়, তার ফল ব্যাপক অর্থে ভুগতে হতে পারে দেশের অর্থনীতিকে। বিশ্বের আর্থিক বাজারও ভারত সম্পর্কে সন্দিগ্ধ
হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং এই বিষয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আন্তরিক ও কড়া পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।