গত শুক্রবারের পর রাজনীতি এবং তার বাইরের মহলে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন একটাই, সিনেমা কি জনসভা বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারের থেকেও বড় মাধ্যম? লোকসভা ভোটের মতো মেগা শো যদি আসন্ন হয়, তাহলে উত্তরটা অবশ্যই হ্যাঁ। ১১ জানুয়ারির অনেক আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদির নিন্দুকরা বলতে শুরু করেছেন, নির্বাচনের আগে কংগ্রেসকে নাস্তানাবুদ করতেই ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ মুক্তি পাচ্ছে। কংগ্রেস প্রতিবাদ জানিয়েও বলল, মুক্তি পাক। আমরা ছবির প্রদর্শন বন্ধ করতে বলব না। মানুষ বিচার করবে। যদিও চিত্রনাট্যে খানিকটা বদল সিনেমা মুক্তি পাওয়া মাত্রই হল। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কংগ্রেসের বিক্ষোভ, প্রদর্শন বন্ধ হল। একটি মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকে তো পর্দাও ছিঁড়ে দিল বিক্ষোভকারীরা। গোরু তাড়ানোর মতো বের করে দেওয়া হল দর্শকদের। বক্তব্য কী? অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার ছবিতে কংগ্রেস তথা সোনিয়া গান্ধীকে অপমান করা হয়েছে। যা দেখানো হয়েছে, তা আদৌ সত্যি নয়। মনমোহন সিংও বিবৃতি দিয়ে আগে জানিয়েছিলেন, বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই।
ছবিতে সত্যিই ডিটেলিংয়ের প্রচুর অভাব রয়েছে। এমনকী, এমনও দেখানো হয়েছে, মন্ত্রিসভা ঘোষণার আগেই ছবির সূত্রধর জনে জনে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন ‘আপনি কোন মন্ত্রক পাচ্ছেন’। যা হাস্যকর। তাহলে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ অনুপম খের এমন একটা ছবি কেন করলেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দাবি করেছেন, এই ছবির মাধ্যমে আসলে সোনিয়াজি এবং রাজীবজির সম্মানহানি করা হয়েছে। এবং এই দাবিটি একার্থে সত্য। সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে মনমোহন সিংয়ের সম্পর্ক এতটাও খারাপ ছিল না। তাই যদি হতো, তাহলে দ্বিতীয় ইউপিএ জমানাতেও তাঁকেই সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী করতেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানেই বিজেপির লাভ। এবং কংগ্রেসের ক্ষতি। ১০টা জনসভায় বক্তৃতা দিয়েও একজন বিজেপি নেতা যা করতে পারতেন না, তা একটা সিনেমা করে দেবে। সাধারণ মানুষের অবচেতনে বিজেপির পক্ষে এবং কংগ্রেসের বিপক্ষে বীজ রোপণ করবে। যার ডিভিডেন্ড মিলবে আসন্ন লোকসভা ভোটে।
একদিকে কংগ্রেসের নেগেটিভ প্রচারমার্কা অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার, তো অন্যদিকে মোদি সরকারের ইতিবাচক কাজকর্মের তালিকায় সবার উপরে গুরুত্ব পাওয়া সার্জিকাল স্ট্রাইক। সে নিয়েও ছবি মুক্তি পেল গত শুক্রবারই... ‘উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’। এর থেকে বিজেপির লাভ কী? মানুষ স্ক্রিনে দেখল, কীভাবে উরি হামলার বদলা নিল ভারতীয় সেনা। আর তার জন্য যাবতীয় সমর্থন জুগিয়ে গেল বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার। ‘নতুন ভারতের উদয়’ হয়েছে, যেখানে আমরা আর হামলা সহ্য করি না। ঘরে ঢুকে জবাব দিয়ে আসি। এই ছবিও কিন্তু ভোটের আগে মোদি সরকারের জন্য প্রচারের আর এক জিয়নকাঠি হতেই পারে। কারণ, বাজারে একটা চলতি কথা আছে, পাকিস্তান ইস্যু চলে ভালো। একটু দেশাত্মবোধের সুড়সুড়ি, পাকিস্তান বিরোধী প্রচার ভোটারের রক্ত গরম করবে। নিন্দুকে তো আরও বলে, সীমান্তে যদি উত্তেজনা বাড়ে, তাহলে খেয়াল করবেন তো, সামনে কোনও ভোট আছে কি না!
আসলে এদেশের মানুষ এখনও আবেগের বশেই ভোটযন্ত্রে মতামত জানিয়ে থাকেন। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু বা রাজীব হত্যা কংগ্রেসকে বিপুল ভোটে জিতিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল। মানুষ মনে করতেই পারে, যে পাকিস্তান দিনের পর দিন আমাদের ঘরে জঙ্গি ঢোকাচ্ছে, নিরপরাধ ভারতীয়দের খুন করছে, সেই দেশের বিরুদ্ধে মোদিই সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর এর প্রভাব ভোটে পড়বেই।
তবে এর পাশাপাশি আরও একটা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার বিজেপির জন্য আবার ব্যুমেরাং হয়ে যাবে না তো? মমতা প্রতিবাদ শুরু করেছেন। তিনি অকংগ্রেসি, অবিজেপি জোটের অন্যতম কৌঁসুলি হওয়া সত্ত্বেও। এবার তাঁর দেখানো পথে যদি রাজনীতি বা তার বাইরের বিশিষ্ট লোকজনও হাঁটতে শুরু করেন, তাহলে মানুষ কিন্তু বিশ্বাস করতেই পারে, গোটাটাই ভুয়ো। তখন আবার সেটা কংগ্রেসের পক্ষে শাপে বর হবে।
সিনেমা অবশ্যই ভালো প্রচার মাধ্যম। কিন্তু এই প্রচারে কতটা লাভ হল? সেটা বোঝা যাবে লোকসভা ভোটের ফলাফলে।