কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) বিশ্বে প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করার দু’দশকেরও কিছু বেশি সময়ের পর ১৯৫৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ছোট একটি ট্রান্সমিটার এবং অস্থায়ী স্টুডিও থেকে প্রথমবার দূরদর্শনের পরীক্ষামূলক সম্প্রচার হয়। ইউনেস্কোর সহযোগিতায় এই কাজ শুরু। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৬১ সালে স্কুল শিক্ষা, টেলিভিশন সম্প্রচারকে এরসঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রচারের পরিধি বাড়ানো হয়। অল ইন্ডিয়া রেডিওর তত্ত্বাবধানে ১৯৬৫ সাল থেকে প্রতিদিনব্যাপী সম্প্রচার শুরু হয়। ওই বছরই প্রথম পাঁচ মিনিট দীর্ঘ খবরের বুলেটিন শুরু হয়। প্রতিমা পুরী দূরদর্শনের প্রথম সংবাদ উপস্থাপিকা ছিলেন। ১৯৬৭ সালে আসেন সালমা সুলতান। তারপর থেকে সরলা মাহেশ্বরী, শীলা চমন, মিনু তলওয়ারের মতো একাধিক মহিলা সংবাদ উপস্থাপিকতা দূরদর্শনে কাজ করেছেন। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ফলে দেশে টেলিভিশনের দ্রুতগতিতে বৃদ্ধির সূচনা হয়। এগুলি হল— ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৬-র জুলাই পর্যন্ত পরিচালিত উপগ্রহের মাধ্যমে শিক্ষামূলক টেলিভিশন সম্প্রচার বা ‘সাইট’ প্রকল্প। এতে দেশের ছ’টি রাজ্যে গ্রামাঞ্চলে একটি উপগ্রহ ব্যবহার করে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতে থাকে। এর মূল লক্ষ্য ছিল, টেলিভিশনকে উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা। যদিও সম্প্রচারের মধ্যে কিছু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর ফলে, টেলিভিশন সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসে। এরপর, ১৯৮২ সালে দেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ ‘ইনস্যাট-১এ’ কাজ করতে শুরু করলে দূরদর্শনের সমস্ত আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলির মধ্যে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সেই প্রথম দূরদর্শন দিল্লি থেকে অন্য সমস্ত দূরদর্শন কেন্দ্রের জন্য জাতীয় অনুষ্ঠান শুরু করে।
১৯৭২ সালে ভারতে টেলিভিশনের প্রথম বড় আকারের সম্প্রসারণ করা হয়। এই সময় মুম্বইয়ে দ্বিতীয় টেলিভিশন কেন্দ্রটি খোলা হয়। এরপর শ্রীনগর এবং অমৃতসরে ১৯৭৩ সালে এবং কলকাতা, মাদ্রাজ এবং লখনউ-এ ১৯৭৫ সালে টেলিভিশন কেন্দ্র খোলা হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভারতের ৭টি শহরে টেলিভিশন পরিষেবা সরবরাহকারী ছিল। ততদিন পর্যন্ত দূরদর্শনই ভারতের একমাত্র টেলিভিশন পরিষেবা সরবরাহকারী ছিল। খানিকটা থেমে থেমে এবং সাদা-কালো ছবি টেলিভিশনে সম্প্রচার হতো। ১৯৭৬ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও ও দূরদর্শন আলাদা হয়ে যায়। লোগো তৈরির ভার পড়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের পড়ুয়াদের উপর। মোট ১৪টি নকশার মধ্যে থেকে বাঙালি ছাত্র দেবাশিস ভট্টাচার্যের আঁকা লোগোটি পছন্দ করেন দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। চীনের মানুষ ‘ইয়িন–ইয়াং’ নীতিতে বিশ্বাস করেন। তাঁদের মতে, দুই বিপরীত শক্তি মিলিত হলেই কোনও কিছু সম্পূর্ণ হয়। সেই নীতি থেকেই দূরদর্শনের নকশা এঁকেছিলেন দেবাশিস ভট্টাচার্য। মাঝখানে মানুষের চোখ, এবং তার উপরে এবং নীচে ঢেউ খেলানো দুটি রেখা। সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ একটি বৃত্ত। সঙ্গে দূরদর্শনের বিখ্যাত সেই সিগনেচার টিউন। আধুনিক জ্যাজ-পপের যুগে সেই টিউন যতই পুরনো হয়ে যাক না কেন, এখনও কোনও বাড়ির অন্দরমহল থেকে এই টিউন ভেসে আসলে পুরনো স্মৃতির পাতা খুলে বসেন না, এমন মানুষ বোধহয় কম। তারও তো একটা ইতিহাস আছে।
ইন্দিরা গাঁধী তখন প্রধানমন্ত্রী। দূরদর্শনের জন্য ‘সিগনেচার টিউন’ তৈরি করতে রবিশঙ্করকে অনুরোধ করলেন। দূরদর্শনের অনুষ্ঠান শুরুর আগে শোনা যাবে যে আবহসঙ্গীত। ১৯৯৭-এর ৮ মার্চ আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে এক সাক্ষাৎকারে পণ্ডিত রবিশঙ্কর নিজেই বলেছিলেন ইন্দিরার সেই অনুরোধের কথা। অনেক আগে তাঁরই সুরে ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আর্জি, দূরদর্শনের জন্য ওই রকম একটা সুর হলে ভালো হয়! রবিশঙ্কর জানিয়েছিলেন, ইন্দিরার প্রস্তাব তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’-র প্রথম লাইনের সুরের আদলেই রবিশঙ্কর টিউনটি বানালেন। মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধায় তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘মোহনকোষ’ রাগ সৃষ্টি করেছিলেন রবিশঙ্কর। পণ্ডিত রবিশঙ্কর টিউনটি কম্পোজ করেছিলেন। আর এই সানাই-এর টিউনটি বাজানোর জন্য কলকাতার ৬১ বি ক্যানিং স্ট্রিট থেকে আলি আহমেদ হুসেনকে নিয়ে গিয়েছিলেন দিল্লি। অসম্ভব নস্ট্যালজিক একটা টিউন। ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানের সুরের পর গোটা দেশে সব চেয়ে জনপ্রিয় সুর এটিই। যা নিয়ে ১৯৭৬ সালের ১ এপ্রিল নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে দূরদর্শন।
কলকাতা দূরদর্শন মানেই একঝাঁক স্মৃতির কোলাজ। সেই ইতিহাস ছুঁতে গেলে ফিরে যেতে হয় সেই ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ৯ আগস্ট বাঙালির জীবনে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে কলকাতায় এসেছিল টেলিভিশন। প্রথম যে পঞ্চাশ মিনিটের ছোট্ট অডিও-ভিস্যুয়াল এপিসোডটুকু দিয়ে যাত্রারম্ভ, রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে তা রেকর্ড করা হয়েছিল। দেশে তখন জরুরি অবস্থা। তারই মধ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হাতে দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতার উদ্বোধন। সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের তরুণ তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশ টিভির সেই সময়কার ডিরেক্টর জেনারেল জামিল চৌধুরী কয়েকজন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। সেদিন টেলিভিশনের পর্দায় প্রথম যে মুখটি ভেসে উঠেছিল, তা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তের। সুব্রত কর, শাক্যসিংহ ধর আর বনবিহারী পাহাড়ি ছিলেন স্টুডিওতে ক্যামেরাম্যান। ধ্রুব মিত্র ফ্লোর ম্যানেজার। একটা লম্বা প্যান শটের পরে শর্মিষ্ঠার মিড শট। শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তে হাত জোড় করে ঘোষণা করেছিলেন: নমস্কার, আজ থেকে কলকাতা টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হল...। কিন্তু টিভি কিনে ফেলা তখন তো খুব সহজ ছিল না। টিভির অনুষ্ঠান দেখতে গেলে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হতো। তার জন্যও একটা খরচ ছিল। টিভি লাইসেন্সের দিক থেকে এক নম্বর লাইসেন্স ছিল বি কে সাহা পরিবারের। তাঁরা বড় চা-ব্যবসায়ী ছিলেন। ফলে সেই বিপ্লবের তরঙ্গ বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছতে অনেক সময় লেগেছিল। বাড়ির ছাদে ছাদে তখন অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্টেনা আকাশপানে চেয়ে থাকত। বাতাসে দৃশ্য-শ্রাব্য তরঙ্গ ধরে ফেলে টিভি সেটে চালান হতো।
১৯৭৫-এর বাংলার দূরদর্শন ছিল পথিকৃৎ। ভরাট ব্যারিটোন এবং নিজস্ব ‘অক্সোনিয়ান’ উচ্চারণে ইংরেজি খবর পড়তেন অধ্যাপক এন বিশ্বনাথন। ছিলেন আর এক দিকপাল লীনা সেন। বাংলা খবর পড়তেন কারা মনে পড়ছে? দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস বসু, দেবরাজ রায়, তরুণ চক্রবর্তী, ছন্দা সেন, কমলিকা ভট্টাচার্য। কিছুদিনের জন্য দীপক চক্রবর্তী। যিনি তখন বাংলা সিনেমার রুপোলি পর্দা কাঁপাচ্ছেন ‘চিরঞ্জিত’ নামে! আরও পরে মধুমন্তী মৈত্র, রায়া ভট্টাচার্য, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা মণ্ডল, দেবাশিস রায়চৌধুরী। আর অনুষ্ঠান ঘোষণা করতেন মূলত শাশ্বতী গুহঠাকুরতা এবং চৈতালী দাশগুপ্ত। পরে আরও অনেকে। এছাড়া নিয়মিত যেসব অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো, প্রথমেই মনে পড়বে, শনিবার বিকেলে একটি সিনেমা। আর সপ্তাহের মাঝে এক এক দিন এক এক রকম অনুষ্ঠান। একদিন ‘চিত্রমালা’ (বাংলা সিনেমার গান)। কয়েকদিন টেলি-ধারাবাহিক। যা এককথায় সিরিয়াল। একদিন ‘দর্শকের দরবারে’। একদিন ‘সাপ্তাহিকী’। হিন্দি অনুষ্ঠান বাংলার ঘরে ঘরে তেমন জনপ্রিয় না হলেও ‘চিত্রহার’ (হিন্দি সিনেমার গান)। রবিবার বিকেলে হিন্দি সিনেমা আর আরও পরে শুরু হওয়া রবিবার সকালের ‘রঙ্গোলি’ (এও হিন্দি সিনেমার গান, সঙ্গে বিশেষ প্রাপ্তি হেমা মালিনী বা শর্মিলা ঠাকুরের মতো তারকা-নায়িকাদের সঞ্চালনা) খুব জনপ্রিয় ছিল। ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে দেশে এশিয়ান গেমস-এর আয়োজন করা হয়েছিল এবং এই গেমস-এর সম্প্রচারের সময় থেকেই রঙিন ছবির সম্প্রচার শুরু। আটের দশক ছিল দূরদর্শনের বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিয়াল ‘হামলোগ’ (১৯৮৪),‘বুনিয়াদ’ (১৯৮৬-’৮৭) এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ ‘রামায়ণ’ (১৯৮৭-’৮৮) এবং মহাভারত (১৯৮৮-’৮৯)-এর মতো পৌরাণিক কাহিনী দেখতে দূরদর্শনের সামনে ভিড় করত। নয়ের দশকের প্রথম দিকে আমাদের দেশে টেলিভিশনের রমরমাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল, তা হল উপগ্রহ টেলিভিশনের মাধ্যমে সিএনএন-এর মতো বিদেশি অনুষ্ঠানের সম্প্রচার। স্টার টিভি, জি-টিভি এবং সান-টিভির মতো আমাদের দেশের চ্যানেলগুলি ভারতের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। এরপর সরকার পর্যায়ক্রমে টেলিভিশন সম্প্রচারসংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করলে ভারতে টেলিভিশনের সম্প্রচার বাড়ে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কেবল টেলিভিশন সম্প্রচার পারিবারিক বিনোদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনে দেয়।
ভাবতে অবাক লাগে, কলকাতা দূরদর্শন ছিল দেশের ‘জরুরি অবস্থা’-র সন্তান। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে এই বিশেষ আপৎকাল ঘোষণার দেড় মাস পর যার সূচনা। সরকারি বিশ দফা কার্যক্রমের প্রচারে দূরদর্শন তখন উপহাসের পাত্র। ৪১টা বছর পেরিয়ে বহু ঘটনার ক্লোজ-আপে ভরে ওঠা স্মৃতির ক্যানভাস আগলে সেই দূরদর্শন। যান্ত্রিকতায় পরিপূর্ণ জীবনে এক পশলা শান্তি সাদাকালো টেলিভিশনের বর্ণিল স্মৃতি। চারকোণা ম্যাজিক বাক্সের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদেরও স্মৃতি, আবেগ, কত অনুভূতি।