সুকান্ত বেরা: প্রস্তুতি প্রায় শেষ। দেশের মাটিতে অনুষ্ঠেয় প্রথম গোলাপি বলে দিন-রাতের টেস্টের বল গড়াতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। সকাল থেকেই গ্যালারিতে বাজছে ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...। বদলে গিয়েছে ক্লাব-হাউসের ঘরে-বাইরের চেহারাও। রাখা হয়েছে বড় বড় কাট-আউট। ঝলসে উঠছে গোলাপি আলোর রোশনাই। অতিথিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে বঙ্গীয় ক্রিকেটের সদর দপ্তরে চলছে পুলিসের চিরুনি তল্লাশি। ইডেন যেন ক্রিকেটের মহাকুম্ভ। শাহি স্নানের অপেক্ষায় হাজার হাজার ক্রিকেটজনতা। ঐতিহাসিক ম্যাচ ঘিরে উন্মাদনা যেমন রয়েছে, উঁকি দিচ্ছে অনেক প্রশ্ন। গোলাপি বলে দিন-রাতের খেলাই কি তাহলে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ? ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলিও গোলাপি জ্বরে আক্রান্ত। দেশের মাটিতে প্রথমবার দিন-রাতের টেস্ট খেলতে নামার আগে তিনিও বেশ আবেগতাড়িত। তবে এটা মানতে তিনি রাজি নন যে, শুধুমাত্র গোলাপি বলে দিন-রাতের খেলাই টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। বিরাট বলেছেন, ‘শুধু দিন-রাতের ম্যাচ কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় নয়। এরকম ম্যাচ উন্মাদনা ফেরাতে পারে। এটা অনেক বেশি বিনোদনমূলক। শুধু রোমাঞ্চ ও মনোরঞ্জনের ভিত্তিতে টেস্ট ক্রিকেট আদৌ টিকে থাকবে বলে আমার মনে হয় না। টেস্ট খেলায় ব্যাটে-বলের লড়াই প্রতিটি সেশনে উপভোগ্য হয়। শীতের সকালে কুয়াশার চাদর সরিয়ে শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে ব্যাট করতে নামলে যে শিহরণ জাগে শরীরে, তার মধ্যে অন্য মাদকতা লুকিয়ে থাকে। যাঁরা টেস্ট ক্রিকেটকে ভালোবাসেন, তাঁরা আগেও মাঠে আসতেন, এখনও আসবেন। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটে-বলের লড়াইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকা দরকার। গোলাপি বলের টেস্টে প্রথম এক ঘণ্টা আকর্ষণীয় হবে। এটা ঐতিহাসিক টেস্ট। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে, দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে দিন-রাতের টেস্ট খেলার সুযোগ পাচ্ছি। এমন উন্মাদনা শেষবার ইডেনে দেখেছিলাম টি-২০ বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে। সেই ম্যাচেও তারকা সমাগম ঘটেছিল। টেস্ট খেলার জন্য এটা খুবই ভালো লক্ষ্যণ। তবে গোলাপি বলের টেস্ট যেমন বিনোদনমূলক, চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি।’
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মধ্যে প্রথম দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচটি খেলা হয়েছিল। অতীতে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট খেলার প্রস্তাব পেলেও ভারতীয় দল রাজি হয়নি। কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলি ভারতীয় ক্রিকেটের মসনদে বসেই তিন সেকেন্ডের মধ্যে বিরাটকে দিন-রাতের টেস্ট খেলতে রাজি করিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে টেনে ভারত অধিনায়ক বলেন, ‘গোলাপি বলে টেস্ট আমরাও খেলতে চাই। ক্রিকেটের স্বার্থে যে কোনও পরিবর্তনকেই স্বাগত জানাতে তৈরি আমরা। কিন্তু বিদেশের মাটিতে হঠাৎ করে কোনও সফরসূচিতে পিঙ্ক টেস্ট অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক নয়। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা গোলাপি বলে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও পেতাম না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও গোলাপি বলে খেলার অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, গোলাপি বলে প্রথম আমরা ঘরের মাঠে টেস্ট খেলে দেখে নিতে চাই। কোকাবুরা বল নিয়েও আমাদের কিছু আপত্তি ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নতুন কিছুতে সব সময়ই স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু সেটা নিয়ম মেনে করা দরকার।’
শুধু দেশে নয়, উপ-মহাদেশের মাটিতে এই প্রথম গোলাপি টেস্টের আসর বসছে। তার আসল কারিগর কিন্তু বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি। আগামী দিনে ভারতীয় দল আরও বেশি করে গোলাপি টেস্ট খেলতে আগ্রহী। রাহুল দ্রাবিড়ের বক্তব্য টেনে বিরাট জানান, ‘টেস্ট ক্রিকেটের একটা ক্যালেন্ডার হওয়া দরকার। তাতে আমাদের মতো দর্শকদেরও সুবিধা হবে। সেক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই টেস্ট ম্যাচ দেখার পরিকল্পনা করে টিকিট কেটে রাখতে পারবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। এখন কাজ ফেলে কেউ আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঠে গিয়ে টেস্ট খেলা দেখতে যেতে পারেন না। মরশুমের শুরুতেই একটা ক্যালেন্ডার তৈরি হলে সবাই উপকৃত হবে।’
গোলাপি বলে কাজটা অনেক বেশি কঠিন হবে ফিল্ডারদের। এমনটাই মনে করছেন ক্যাপ্টেন কোহলি। তিনি জানিয়েছেন, ‘এসজি বোলাপি বল বেশ শক্ত। অনেকটা হকি বলের মতো লাগছে। আমরা যখন কেরিয়ারের শুরুতে সিন্থেটিক ক্যাম্বিস বলে খেলতাম, তেমনটা মনে হচ্ছে। গোলাপি বলের উপর অতিরিক্ত পালিস থাকায় হড়কে যাচ্ছে। লাল বলের তুলনায় এই বল গ্রিপ করতে সমস্যা বেশি উইকেটরক্ষকদের। দিনের বেলায় বল উঁচুতে উঠলে দৃশ্যমানতার সমস্যা হচ্ছে। ক্যাচ ধরার সময় হাতের তালু সময় মতো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে পারছি না।’
নতুন বলে প্রথম সেশনে ব্যাটসম্যানদের বিপদ অনেক বেশি। এই প্রসঙ্গে কোহলি বলেন, ‘বলের রং ধরে রাখতে উইকেটে একটু বেশি ঘাস রাখা হচ্ছে। তার সঙ্গে গোলাপি রংয়ের গ্লেজ বেশি থাকায় স্কিড করছে। মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। প্রথম দিনের খেলার পর বুঝতে পারব, ম্যাচে শিশির কত বড় ফ্যাক্টর হবে।’