বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
২০০৬ থেকে ২০১১, এই পর্বে ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৬ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলে গুরপ্রীত সিং সান্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তনুময় বসু। তাঁর কাছেই গোলরক্ষার প্রাথমিক পাঠ নেওয়া এই পাঞ্জাবতনয়ের।
অতনু ভট্টাচার্যের চোখে
প্রতিদিনই গুরপ্রীত উন্নতি করছে। এই মুহূর্তে ও এশিয়ার অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। সাড়ে ছ’ফুট উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে গুরপ্রীত ভরসা জোগাচ্ছে ভারতীয় দলকে। সুনীল ছেত্রী না খেলায় মঙ্গলবার গুরপ্রীতই ছিল অধিনায়কের দায়িত্বে। ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ শব্দবন্ধ সামান্য বদলে বলা যেতেই পারে ‘লিডিং ফ্রম দ্য বিহাইন্ড’। কাতারের বিরুদ্ধে যে খেলা গুরপ্রীত মেলে ধরেছে তারজন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। ১৯৮৬ সালে এশিয়ান অলস্টারের হয়ে খেলতে কাতারে গিয়েছিলাম। তবে সেই কাতারের সঙ্গে এই কাতারের অনেক পার্থক্য। এখন ওরা এশিয়ার সেরা। মঙ্গলবার কমপক্ষে সাতটি অনবদ্য সেভ করেছে গুরপ্রীত। গ্রিপিং, আউটিং কিংবা একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে ও ক্রমশ ভুলত্রুটি শুধরে নিচ্ছে। ‘রিচ’ বেশি বলে ওর শ্লথতা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বিদেশে খেলতে যাওয়াটাই ওর টার্নিং পয়েন্ট। ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে বাজে গোল হজম এখনও অনেকে মনে রেখেছেন। মানছি, সেবার ওই ম্যাচে হারের জন্য আমরা আই লিগ পাইনি। কিন্তু লাল-হলুদ জার্সিতে গুরপ্রীত বেশ কিছু অসাধারণ ম্যাচ খেলেছে। মনে পড়ছে, হাওড়া স্টেডিয়ামে বিএনআরের বিরুদ্ধে লিগের ম্যাচে ও পেনাল্টি সেভ করেছিল। আমরা জিতেওছিলাম। কলকাতা ময়দান ওকে অবশ্যই পরিণত করেছে। চাপ নিয়ে খেলার অভ্যাস হয়েছে এখানেই। তবে জাতীয় দলে খেলা অপেক্ষাকৃত সহজ। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা দলগুলির বিরুদ্ধে ম্যাচে গোলরক্ষককে সবসময় সজাগ থাকতে হয়। ক্লাব লেভেলে তা হয় না। স্বাভাবিকভাবেই গা-ছাড়া ভাব আসে। আশা করব, গুরপ্রীত এই অসুখে ভুগবে না। বয়স মাত্র ২৭। তাই ওর কাছ থেকে আরও চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্সের অপেক্ষায় রইলাম। বুধবার অনেকে আমায় জিগ্যেস করেছেন গুরপ্রীতের প্লাস পয়েন্ট সম্পর্কে। আমি তাঁদেরকে বলেছি, শেখার আগ্রহই ওর সবচেয়ে বড় গুণ। এছাড়া লম্বা গোলকিক মারতে পারে সান্ধু। আধুনিক ফুটবলে গোলরক্ষক শুধু ‘লাস্ট লাইন অব ডিফেন্স’ নয়, ‘ফার্স্ট লাইন অব অ্যাটাক’ও। কাতারের বিরুদ্ধে ম্যাচেও ওর লম্বা গোলকিক বারবার উদান্তাদের খুঁজে নিয়েছে।
তনুময় বসুর চোখে
কলিন টোলের আমলে গুরপ্রীতকে প্রথম দেখি। ও কিন্তু ইন বর্ন গোলকিপার নয়। কিন্তু উচ্চতার কারণেই ওকে দেখিয়ে কলিন টোল বলেছিলেন, ‘শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে পারলে গুরপ্রীত আন্তর্জাতিক মানের গোলকিপার হতে পারবে।’ সেই শুরু। দুরন্ত প্রতিভা না হলেও স্রেফ পরিশ্রমের জোরে আজ ও এই জায়গায় পৌঁছেছে। ১৫ বছর বয়সেই ওর উচ্চতা ছিল প্রায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। প্র্যাকটিসে যা বলতাম মন দিয়ে শুনত। গোয়ায় মাসের পর মাস বালিতে কিংবা মাঠে ঘামরক্ত ঝরিয়েছে গুরপ্রীত। শুধু প্র্যাকটিস নয়, অনূর্ধ্ব-১৬ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ স্তরে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাও ওকে সাফল্যের পথে পা বাড়াতে সহযোগিতা করেছে। মনে পড়ে, গোয়ার হোস্টেলে এক সন্ধ্যায় আমার কাছে এসে গুরপ্রীত আক্ষেপের সুরে বলেছিল, ‘স্যার সবাই টিম পেল। কিন্তু আমি এখনও ফাঁকা।’ কোচ হিসেবে আমারও কিছু দায়িত্ব ছিল। তাই ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে কথা বলে গুরপ্রীতকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। বেশ কয়েক বছর ইস্ট বেঙ্গলে থাকলেও ও সেভাবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেনি। এরপর নরওয়ের স্টাবেক এফসি’তে গিয়ে গুরপ্রীত সবদিক থেকেই সমৃদ্ধ হয়। কাতারের বিরুদ্ধে ম্যাচ সম্ভবত এখনও পর্যন্ত ওর জীবনের সেরা। ওই মঞ্চ গুরপ্রীতকে পরিণত করেছে। অনবদ্য রিফ্লেক্স, বুদ্ধিদীপ্ত ডিস্ট্রিবিউশন ও জোরালো গোল কিক ওর সম্পদ। তবে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ওকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। পাশাপাশি আশা করব, ক্লাব লেভেলেও গুরপ্রীত যেন দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে। মাটি ঘেঁষা শট রোখার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এখন ও অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। বেড়েছে আত্মবিশ্বাসও। গুরপ্রীত এখনও আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। দেখা হলে নিশ্চয়ই পরামর্শ দেব। ওকে নিখুঁত করে তুলতে পারলে ছেলেবেলার কোচ হিসেবে নিশ্চয়ই তৃপ্তিতে মন ভরে যাবে।