পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
নবদ্বীপ পুরসভার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মালঞ্চপাড়ায় আচার্যপাড়া লেনে প্রায় এক বিঘে জমির ওপর বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটে অবহেলিত হলেও সেই জন্মভিটে নিয়েও দ্বন্দ্ব চরম। জন্মভিটার অধিকাংশ জমিও বেদখল হয়ে গিয়েছে। সনাতন মিশ্রের ওই বাড়িতেই খড়ের চালার ঘরে বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্ম হয়েছিল। সেই ঘটনার স্মারক হিসেবে জন্মভিটে সংরক্ষণের কথা উঠলেও কেউ কোনও উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ। রিকশওয়ালারা বাইরের দর্শনার্থীদের নবদ্বীপের বহু মন্দির ঘোরালেও বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটে দর্শন করায় না।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ভিটেও ছিল জঙ্গলে ভরা। বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতা নিবাসী দুই ভক্তের আর্থিক সহায়তায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের সংস্কার করা হয়। তখনও বিষ্ণুপ্রিয়ার এই জন্মভিটে নিয়ে কোনও তাপ-উত্তাপ ছিল না জনমানসে। শ্রীপঞ্চমীর পুণ্যতিথিতে সরস্বতী পুজোর দিন বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মদিন হওয়া সত্ত্বেও কোনও উৎসবও আগে হতো না। বছর ৪০-৪৫ আগে মালঞ্চপাড়ার কৃষ্ণদাস সাহারায় বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মতিথি পালনের উদ্যোগ নেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে সেই অনুষ্ঠান কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে তিন থেকে পাঁচদিনের জন্মতিথি পালন উৎসব হয়ে থাকে। ১৯৮৪ সালে জনৈক ভক্তের আর্থিক দানে চৈতন্য মহাপ্রভু ও বিষ্ণুপ্রিয়ার যুগলমূর্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন মন্ত্রী কিরণময় নন্দ বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটে ঘুরে দেখে তা সংরক্ষণের আশ্বাসও দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নেই কোনও সরকারি সাহায্য।
এদিকে, বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটে কার দখলে থাকবে তা নিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতি ও বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির জোর দ্বন্দ্ব চলছে। আপাতত বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির দখলেই রয়েছে জন্মভিটের প্রায়এক বিঘে জমি। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাই যাদবাচার্যের ছেলে মাধবাচার্যকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন স্বয়ং বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী। সেই মাধবাচার্যর বংশধরেরাই এখন মহাপ্রভু বাড়ির সেবাইত। তাঁরা বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতি গড়েছেন মহাপ্রভু বাড়ি ও জন্মভিটের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। তাঁদের দাবি সনাতন মিশ্রের এই জমির ওপর একমাত্র অধিকার তাঁদেরই। এনিয়ে তাঁরা আদালতেও যান। আদালতের রায় নিয়ে পুলিসি সাহায্যে ওই জমি দখল করতে গেলে বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির লোকজন তাঁদের বাধা দেন বলে অভিযোগ।
বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির বর্তমান সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী বলেন, আমরা চেয়েছিলাম নিজেদের উদ্যোগে তীর্থযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করে জন্মভিটেয় নিত্যসেবার আয়োজন করতে। যেহেতু বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটেতে আমাদের নিত্যপুজোর সুযোগ নেই, সেহেতু আমরা রীতি অনুযায়ী জগদ্ধাত্রী পুজোর আগের দিন গোষ্ঠ অষ্টমী তিথিতে প্রতিবছরই সন্ধ্যায় মহাপ্রভুর বাড়ি থেকে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে নগর পরিক্রমা করে চিড়ে মালসা ভোগ নিয়ে যাই বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটেতে। বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির সদস্যদের দাবি, বিষ্ণুপ্রিয়ার কিংবা তাঁর ভাইয়ের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁদের হাতেই জন্মভিটের দায়িত্ব তুলে দেওয়া উচিত।
বিষ্ণুপ্রিয়া জন্মভিটে মন্দিরের বর্তমান সেবাইত বাসুদেব সাহা এক সময় বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির সম্পাদক ছিলেন। তিনি বলেন, এখানে একই আসনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও বিষ্ণুপ্রিয়া পুজো পান। প্রতিদিন পাঁচ বার পুজো হয়। এক সময় সনাতন মিশ্রের এই বাড়ি সহ প্রায় ১৮ বিঘা সম্পত্তি ছিল। এখন সেই জমি ১৮ কাঠায় ঠেকেছে। চারদিক থেকে লোকে বেদখল করে নিচ্ছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটের এই বেহাল অবস্থা দেখেই পাড়ার কিছু লোক উদ্যোগী হয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতি গঠন করেন। ওই সমিতির তৎকালীন সভাপতি ভুবন ভারতী নবদ্বীপ পুরসভা হেরিটেজ কমিটিকে চিঠি লিখে জানান, এতদিন শহরের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা শুধুমাত্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়েই মাতামাতি করেছেন। বিষ্ণুপ্রিয়া যথারীতি পর্দার আড়ালেই রয়ে গিয়েছেন। নবদ্বীপ পুরসভা উদ্যোগ নিয়ে যদি কিছু করতে পারে তাহলে আমরা সর্বতোভাবে সহযোগিতা করব।
বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির বর্তমান সভাপতি সুদেব দাস বলেন, বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির সদস্যরা আইনি পথে জন্মভিটের দখল পেলেও মালঞ্চপাড়ার বাসিন্দাদের সহায়তায় নিয়মিত সেবা করছেন সেবা সমিতির সদস্যরা। মালঞ্চপাড়ার বাসিন্দা নারায়ণ দেবনাথ বলেন, যখন জঙ্গল হয়ে পড়েছিল জন্মভিটের জায়গা তখন কোনও বন্ধুর খোঁজ পাওয়া যেত না। এখন আমরা ভিক্ষে করে নিত্যসেবা ও মন্দির করে অনেকেরই চক্ষুশূল হয়েছি। সরকারিভাবে সংরক্ষণ হলে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে।
বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির সম্পাদক শঙ্কর দেবনাথ বলেন, হেরিটেজ কনজারভেশন কমিটির মাধ্যমে নবদ্বীপ পুরসভা রাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় এই জন্মভিটেকে সংরক্ষণ করুক এটাই চাইছেন সকলে।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তথা হেরিটেজ কমিটির সদস্য শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, নবদ্বীপ পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের মালঞ্চপাড়ার আচার্যপাড়ায় বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবার বাড়ি ছিল। হেরিটেজ কমিটির কাছে ওই বাড়ি সংরক্ষণের আবেদন পাঠানো হয়েছে। এটা হলে সরকারি অনুদানেই তা সংরক্ষণের কাজ হবে। তখন প্রচারের আলোয় আসতে পারেন বিষ্ণুপ্রিয়া।
তিনি বলেন, ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ভাঙনে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর বাড়ি গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তখন যাঁরা শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর বাড়িতে ছিলেন তাঁরা সবাই মালঞ্চপাড়ায় বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটেতে ফিরে যান। আনুমানিক ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে তোতা রামদাস বাবাজির অনুপ্রেরণায় বর্তমান মহাপ্রভুপাড়ায় মহাপ্রভুর মন্দির তৈরি হয়। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাই যাদবাচার্যর বংশধরের কিছু অংশ মহাপ্রভুপাড়ায় এসে বসবাস করতে শুরু করেন। কেউ কেউ থেকে যান মালঞ্চপাড়ায় আদি বাসস্থানে।