গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
গত বছর নিখোঁজ হওয়ার আগে আরব আমিরশাহির প্রধানমন্ত্রী শেখ মহম্মদ বিন রাশেদ আল-মাকতুমের (৬৯) কন্যা প্রিন্সেস লতিফার সর্বশেষ ছবিটি ছিল একটি সেলফি। ফিনল্যান্ডের নাগরিক, লতিফার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী টিনা জুহাইনেনের পাশে বসে তিনি যখন সেলফিটি তুলছিলেন, তখন তাঁদের গাড়ি দুবাই ছেড়ে ওমানের দিকে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ওমানে গিয়ে এক ফরাসি গুপ্তচরের সঙ্গে তাঁর ইয়টে চেপে ভারতে যাবেন, এরপর সেখান থেকে প্লেনে করে আমেরিকায় গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।
পথ তখনও অনেক বাকি। কিন্তু লতিফার বিশ্বাস ছিল তিনি সহজেই পালিয়ে যেতে পারবেন। আরব আমিরশাহির সীমান্ত পেরিয়ে যখন তাঁরা ওমানে প্রবেশ করেন, তখন তাঁদের মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি। দুই যুবতী ড্রাইভ করে পালিয়ে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে, পিছনে হয়তো আরব আমিরশাহির পুলিস বাহিনী তাদের খোঁজে গোটা দেশ চষে ফেলছে। লতিফা যখন সেলফি তুলছিলেন, তখন টিনা মজা করে নিজেদের তুলনা করেছিলেন ‘থ্যালমা অ্যান্ড লুইজ’-এর সঙ্গে। রিডলি স্কট পরিচালিত ১৯৯১ সালের ওই হলিউড চলচ্চিত্রের প্রধান দুই চরিত্র গাড়িতে করে পুরো আমেরিকা চষে বেড়াতে থাকে, আর আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে একের পর এক অপরাধ করে যেতে থাকে। টিনার তুলনা শুনে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন লতিফা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর এই প্রথম অজানা এক আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তাঁর বুক। কারণ, ‘থ্যালমা অ্যান্ড লুইজ’ চলচ্চিত্রের পরিণতিটা দুই নায়িকার জন্য শুভ ছিল না। টিনার তুলনা এবং লতিফার আশঙ্কা খুব একটা অমূলক ছিল না। তাদেরকে ‘থ্যালমা অ্যান্ড লুইজ’ এর মতো একই পরিণতি বরণ করতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাদের অভিযানও শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। আমেরিকায় পৌঁছনোর অনেক আগে ভারতের কাছাকছি গিয়েই নিখোঁজ হয়ে যান তারা। তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুদীর্ঘ পরিকল্পনা, পালানোর প্রচেষ্টা এবং শেষে নিখোঁজ হওয়ার কোনওটাই থ্যালমা অ্যান্ড লুইজের চেয়ে কম নাটকীয় ছিল না।
সবকিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগচ্ছিল। ইয়ট ছুটে চলছিল ভারতের দিকে। হার্ভে জুঁবে ভারতীয় এক সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। যেন কোনও ঝামেলা ছাড়াই তারা ভারত থেকে আমেরিকার প্লেন ধরতে পারেন। কিন্তু তাদের তখনও ধারণাই ছিল না যে, আরব আমিরাশাহির দক্ষ ভাড়াটে হ্যাকার বাহিনী, যারা কাতারের আমিরের আইফোন পর্যন্ত হ্যাক করে ফেলতে পারে, তারা ততক্ষণে তাদের ফোন ট্র্যাক করে তাদের অবস্থান বের করে ফেলেছে। এবং আমিরাশাহির সঙ্গে রাজনৈতিক মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলেছে। গত বছর মার্চের ৪ তারিখে যখন লতিফাদের ইয়টটি গোয়া সমুদ্রবন্দর থেকে ৩০ মাইল দূরে, তখন ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদেরকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। রাত দশটার সময় দু’টি স্পীডবোটে করে ছয় থেকে আট জন ভারতীয় কমান্ডো ইয়াটের উপর আক্রমণ চালায়। তারা ইয়ট লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে এবং স্মোক গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এরপর ইয়টে উঠে ক্রুদের ধরে ফেলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারে করে সেখানে এসে পৌঁছয় আমিরশাহির অন্তত দশজন চোস্ত সেনা। ভারতীয় কোস্টগার্ডদের কাছে বারবার আশ্রয় চাওয়া সত্ত্বেও লতিফাকে হেলিকপ্টারে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। টিনা, জুঁবে এবং অন্যান্য ক্রুদের ইয়টে করেই ভারতীয় কোস্টগার্ডের প্রহরায় আমিরশাহির ন্যাভাল বেজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়।
ইয়টে ওঠার পর থেকেই লতিফা সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন, যেন তিনি বিপদে পড়লে তারা সংবাদটি কভার করেন। কিন্তু আরব আমিরশাহির প্রধানমন্ত্রীর কন্যার ওমান হয়ে সমুদ্র পথে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কাহিনীটি এতই নাটকীয় ছিল যে, কোনও সাংবাদিককেই তিনি সেটা বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। তার পালানো এবং অপহরনের ঘটনাটি তাই চারদিন পর্যন্ত বিশ্ববাসীর কাছে অজানাই রয়ে যায়। মার্চের ৯ তারিখ ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেল প্রথম তার অপহরণের সংবাদটি প্রকাশ করে। আরব আমিরাশাহির শাসকশ্রেণির ক্ষমতার কারণেই হোক, আর অন্য যেকোনও কারণেই হোক, লতিফার সংবাদটি নিয়ে কিছু মানবাধিকার সংস্থার রুটিন বিবৃতি প্রদান ছাড়া তেমন কোনও আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। প্রায় আট মাস পর, গত ৬ ডিসেম্বর, ঘটনাটি নিয়ে বিবিসি Escape from Dubai: The Mystery of the Missing Princess শিরোনামে দুই পর্বের একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে। এই ডকুমেন্টারি প্রচারিত হওয়ার পর প্রথম শেখ মহম্মদের কার্যালয় থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সেখানে দাবি করা হয়, প্রিন্সেস লতিফা তাদের পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করছেন এবং দু’জনেই ভালো আছেন। এছাড়াও বিবৃতিতে দাবি করা হয়, প্রিন্সেস লতিফার সাময়িক অন্তর্ধান ছিল মূলত প্রাক্তন ফরাসি স্পাই হার্ভে জুঁবে এবং তার সহযোগীদের একটি চক্রান্ত। যারা লতিফার মুক্তির জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করেছিল।
দুবাইয়ের রাজপ্রাসাদের অন্তর্ধান রহস্য এখানেই শেষ নয়! এক আরব রাজকন্যার উদ্দাম জীবনের ফল কী হতে পারে? হয় মৃত্যু না হয় বাকি জীবন সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত হয়ে হারেমের গভীরতম কোণে কাটিয়ে দেওয়া। সব জেনেও গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে পালিয়ে যান দুবাই শাসকের কনিষ্ঠ স্ত্রী হায়া বিনতে আল হুসেন। জার্মানি হয়ে হায়া চলে যান ব্রিটেনে। লন্ডনেই তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছিল, দুবাইয়ের বিপুল বৈভব ফেলে হায়া কেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে পালাতে যাবেন?
বিয়ের আগে প্রবল উদ্দাম জীবন। মুসলিম শাসনের বেড়া ভেঙে অতি উচ্চবিত্ত পরিবারের কন্যা হওয়ার সুবাদে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারিনী। জর্ডনের রাজকুমারী হায়ার শক্ত হাতে তীরের মতো ছুটত নৌকা। রোয়িং করতে পারদর্শী-বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। এমনকি জর্ডনের অলিম্পিক কমিটিতে ছড়িও ঘুরিয়েছেন। সবই ছিল বাপের বাড়ির সুবাদে পাওয়া ক্ষমতা। বিয়ের পর সব বদলে গিয়েছিল। জর্ডনের বাদশাহ আবদুল্লার সৎবোন শেখ হায়া (৪৫) দর্শন,রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির শুভেচ্ছা দূত হিসেবেও কাজ করেন তিনি। ২০০৪ সালে শেখ মহম্মদকে বিয়ে করেন হায়া। তাঁদের দুটি সন্তানও রয়েছে। এমিরেটস উমেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হায়া বলেছিলেন, ‘আমি সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম। দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীর প্রতি আমার আলাদা অনুরাগ আছে।’ ২০১৭ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হায়া আরব দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে মহিলাদের দুর্দশা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। বলেন, তিনি নারীবাদী নন। তবে বিশ্বাস করেন, এখানে নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। তাহলে কি আরব দুনিয়ার মহিলাদের কট্টর বেড়াজাল থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন হায়া? নাকি অন্য কিছু?
আরব আমিরশাহির রাজকীয় আল-মাকতুম পরিবার মানে প্রাচুর্য আর প্রাচুর্য। বিশ্বের অন্যতম ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। শেখ মহম্মদের সম্পত্তির পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ইউরোর সমান বলে অনুমান করা হয়। শেখ মহম্মদ বিন রাশেদ আল-মাকতুম বর্তমানে দুবাইয়ের আমির। বিবিসি জানাচ্ছে, দুবাইয়ের শেখের বয়স ৬৯ বছর। আর তাঁর স্ত্রী হায়ার বয়স ৪৫। ২০০৪ সালে দু’জনের বিয়ে হয়েছিল। আমিরশাহির সংবাদপত্র খালেজ টাইমস জানাচ্ছে, হায়ার আগের পাঁচ পক্ষের সবমিলিয়ে মাকতুম পরিবারে মোট ২৩ জন সন্তান রয়েছে। আর এই পরিবারের সবচেয়ে আলোচিত নাম হায়া। মাকতুমের ষষ্ঠ ও সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী। সম্প্রতি শেখ লতিফার পালিয়ে যাওয়ার পর রহস্যজনকভাবে দুবাইয়ে ফেরত আনার পিছনে পরিবারের অন্দরের অনেক কিছুই নাকি প্রিন্সেস হায়া জেনে যান। এ নিয়ে তার উপর চাপ আসতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন। এরপর পালানোর সিদ্ধান্ত। এখনও পর্যন্ত খবর অন্তত তাই। শেখ লতিফার ওই ঘটনায় দুবাইয়ের ভাবমূর্তি রক্ষায় প্রিন্সেস হায়া সেসময় আইরিশ প্রেসিডেন্ট ম্যারি রবিনসনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।
বসে থাকেননি শেখ মাকতুমও। হায়ার পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। হায়ার সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষ্যাপা শেখ মাকতুম সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে জ্বালাময়ী কবিতাও পোস্ট করেন। সেখানে হায়াকে ‘প্রতারক’ ও ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করেন। অভিযোগ, ১০ লক্ষ পাউন্ড হাতিয়েছেন হায়া। জানা গিয়েছে, এখন হায়া লন্ডনের কেনসিংটন প্যালেস গার্ডেনসে বসবাস করছেন। সম্প্রতি হায়ার ঘনিষ্ঠ একজন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, কয়েক মাস ধরেই হায়া লন্ডনে থাকছেন। প্রাণনাশের ভয় তাঁকে তাড়া করছে। মেয়ে শেখ আল জলিলা ও ছেলে শেখ জায়েদকে নিয়ে সব সময় উচ্ছ্বসিত তিনি। পালিয়ে যাওয়ার সময় সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে যান। লন্ডনেই পাকাপাকিভাবে থাকতে চান। হায়া চাইছেন দুবাই রাজ পরিবারের সঙ্গে দ্রুত পাকাপাকি বিচ্ছেদ। কিন্তু যদি তাঁর স্বামী তাঁকে দুবাই ফিরিয়ে নিতে চান তাহলে ব্রিটেনের জন্য তা কূটনৈতিক মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। কে না জানে, আরব আমিরশাহির সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। ইতিমধ্যে লন্ডনের আদালতে সেই টানাপড়েন শুরু।
হায়া জানেন, একবারে যদি তাঁকে দুবাইতে ফেরত পাঠানো হয় তাহলেই জীবনের ইতি। আরব দুনিয়ার শেখ পরিবারের অন্দরমহলে কী কী ঘটে তা তাঁর থেকে ভালো খুব কম জনেই জানেন। গুটিয়ে আসছে শেখ মাকতুমের জাল, প্রাণভয়ে কাঁপছেন দুবাই কুলবধূ হায়া।
লন্ডনের আদালতে হায়া। -এএফপি