কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
১৯৫০-এর দশকের শেষদিকের কথা। বিশ্ব রাজনৈতিতে তখন বেশ টান-টান উত্তেজনা চলছে। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা স্নায়ুযুদ্ধ তখন গোটা পৃথিবীকে প্রায় দুই শিবিরে বিভক্ত করে ফেলেছে। সরাসরি কোনও যুদ্ধ না হলেও, সব ক্ষেত্রেই চলছিল তাদের তুমুল প্রতিযোগিতা। আর এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছিল তাদের অন্যতম হাতিয়ার। বিশেষ করে মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় দুই পক্ষ যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছিল, তা বিজ্ঞান-প্রেমীদের জন্যে বেশ আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল। তবে, প্রথম মাইলফলকটি সোভিয়েতই অতিক্রম করে। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে মহাশূন্যে পাড়ি জমায় স্পুটনিক। মার্কিন কংগ্রেসে এ নিয়ে তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এভাবে তাদের পিছনে ফেলে দিচ্ছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। কয়েকজন রাজনীতিবিদ তো তখন মহাকাশে সামরিক প্রকল্প শুরু করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এমনকি প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার তাতে সম্মতও হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েকজন উপদেষ্টার পরামর্শে এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন তিনি। এর পরিবর্তে একটি নতুন মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব আনা হয়। সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয় ১৯৫৮ সালে। প্রতিষ্ঠিত হয় নাসা। আগের একটি মহাকাশ সংস্থা NACA-এর সঙ্গে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে যাত্রা শুরু করে নাসা।
নাসার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল মহাকাশে মানুষ পাঠানো। এজন্য ‘প্রজেক্ট মারকিউরি’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। মহাকাশ-দৌড়ে সোভিয়েতকে পিছনে ফেলার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্যটিই ছিল এর মূল প্রভাবক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার সেই হার-জিতের হিসেবের বাইরে এই প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে পরবর্তীতে অ্যাপোলো, জেমিনির মতো বিখ্যাত প্রোগ্রামগুলোর জন্যে প্রযুক্তিগত ভিত তৈরি করে দেওয়া। ১৯৫৯ সালে সাতজন নভোচারী বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রজেক্ট মারকিউরির কাজ শুরু হয়। মূলত সেই সময়ের সামরিক পাইলটদের মধ্যেই এই বাছাইয়ের কাজ চলে। প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। বয়স চল্লিশ বছরের কম হতে হবে। উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির চেয়ে কম হতে হবে। শারিরীকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অভিজ্ঞ হতে হবে। টেস্ট পাইলট স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন থাকতে হবে এবং কমপক্ষে ১৫০০ ঘণ্টা বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। নাসা প্রায় পাঁচশো জনের নথিপত্র ঘেঁটে ওই শর্তাবলী অনুসারে ১১০ জনকে বাছাই করেছিল। এরপর সেখান থেকে শুরু হয় আসল নির্বাচন পক্রিয়া। প্রথমেই পাইলটদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়। গোপনীয়তা রক্ষার শর্ত দিয়ে তাদের জানানো হয় মহাকাশ প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে। প্রথম দুই দল থেকে এই প্রকল্পে যুক্ত হতে এতজন আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন যে, তৃতীয় দলকে আর সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকাই হয়নি। এরপর অত্যন্ত কঠিন সব শারিরীক ও মানসিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে বাছাই করা হয় চূড়ান্ত সাতজনকে। ১৯৫৯ সালের ৯ এপ্রিল তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে নাসা। সঙ্গে সঙ্গেই বিখ্যাত হয়ে উঠেন তারা। তাদের রীতিমতো নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয় পত্র-পত্রিকায়, যারা মহাকাশ প্রকল্পের মাধ্যমে আসলে ‘কমিউজমের বিরুদ্ধে লড়াই’ করতে যাচ্ছেন।
মারকিউরির মূল লক্ষ্য মহাকাশে মানুষ পাঠানোর হলেও, মারকিউরিতে করে প্রথম প্রাণী হিসেবে মহাকাশে যাওয়ার কৃতিত্ব একটি শিম্পাঞ্জির। ১৯৬১ সালের ৩১ জানুয়ারি মারকিউরি রেডস্টোন রকেটে করে মহাকাশে পাড়ি জমায় হ্যাম নামে একটি শিম্পাঞ্জি। মানুষ পাঠানোর আগে পরীক্ষামূলকভাবে নাসা শিম্পাঞ্জিটিকে পাঠিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন, কোনও প্রযুক্তিগত সমস্যা হয় কি না। সমস্যা হয়েওছিল, যে গতিতে যাওয়ার কথা, তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটেছিল মহাকাশযানটি। কিছুটা সমস্যা হয়েছিল অবতরণের ক্ষেত্রেও। তবে শেষ পর্যন্ত হ্যাম সুস্থই ছিল। এরপরে ২৪ মার্চ আরএ একটি পরীক্ষা চালানো হয়। এটি সফল হলে নাসা মহাকাশে মানুষ নিয়ে যেতে সক্ষম বলে মনে করে মারকিউরিকে। প্রথম আমেরিকান হিসেবে মহাকাশে ওড়ার জন্য অ্যালান শেফার্ডকে বাছাই করে নাসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা শেফার্ড ছিলেন নৌবাহিনীর একজন দক্ষ পাইলট।
সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও, নাসা তাদের আসল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। আরও একবার সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হেরে যায় আমেরিকা। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল, পৃথিবীর সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে মহাকাশে পাড়ি জমান ইউরি গ্যাগারিন। গ্যাগারিনকে নিয়ে ভস্তক মহাকাশযানটি প্রদক্ষিণ করেছিল পৃথিবীর কক্ষপথও। তবে আমেরিকাও দেরি করেনি। এর তিন সপ্তাহ পরই পৃথিবী ছেড়ে যান অ্যালান শেফার্ড। শেফার্ড সফলভাবে মহাকাশ ভ্রমণ সম্পন্ন করলেও, সোভিয়েতের কাছে হেরে যাওয়ার আফসোস কখনও ভুলতে পারেননি তিনি। তাছাড়া তার মহাকাশযান ফ্রিডম-সেভেন পৃথিবীর কক্ষপথে আবর্তনও করেনি, বরং ১৫ মিনিটের সময়কালে মহাশূন্যে ছোট বাঁক নিয়ে ফিরে এসেছিল। তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি ছিল নাসার জন্য এগিয়ে চলার প্রথম ধাপ। এরপর একের পর এক অভিযান চালিয়ে নাসা বুঝতে পারে পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যেতে প্রযুক্তিগতভাবে প্রস্তুত তারা। সে জন্য জেমিনি নামে নতুন একটি প্রকল্প শুরু করে তারা। এই প্রকল্পের হাত ধরেই পরবর্তীতে এসেছিল চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রকল্প অ্যাপোলো ওয়ান। যা মহাকাশ দৌড়ের প্রতিযোগিতায় আমেরিকাকে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দিয়েছিল। বর্তমানে মহাকাশ-ভ্রমণের ইতিহাসে জেমিনি ও অ্যাপোলো ওয়ান অনেক বিখ্যাত হলেও, মারকিউরি সম্পর্কে খুব বেশি মানুষের ধারণা নেই। অথচ, এটিই আমেরিকার মহাকাশ অভিযানের ভিত গড়েছিল। মারকিউরির নভোচারীরাই মহাকাশকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল আমেরিকানদের মধ্যে। নাসা থেকে অবসর নেওয়ার পরেও এই কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা।
চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ পাঠিয়ে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ৫০ বছর আগে ‘অ্যাপোলো-১১’ মহাকাশযানে চড়ে তিন মার্কিন মহাকাশচারী গিয়েছিলেন চাঁদে। চাঁদের মাটিতে নেমেছিলেন দুই মার্কিন মহাকাশচারী নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন। সাড়ে ২১ ঘণ্টার জন্য। তাঁরা চাঁদের মাটিতে পুঁতেছিলেন আমেরিকার পতাকা। তুলে নিয়ে এসেছিলেন চাঁদের মাটি। মাইকেল কলিন্স ছিলেন সেই মহাকাশযানের পাইলট। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের সেই ঐতিহাসিক অভিযানের পর ১৯৭২ সালে সর্বশেষ চন্দ্রপৃষ্ঠে যন্ত্র পাঠিয়েছিল নাসা। যদিও এরপর কেটে গিয়েছে কয়েক বছর। প্রযুক্তির কল্যাণে ক্রমশ উন্নতি ঘটছে সর্বত্র। মহাকাশ বিজ্ঞানেও এসেছে বিশাল পরিবর্তন। নাসার পাশাপাশি চাঁদের বুকে অভিযান চালিয়েছে রাশিয়া, জাপান, ইউরোপের একাধিক স্পেস এজেন্সি। চাঁদে বসতি তৈরি করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে মানুষ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই চাঁদের মাটিতে যাতে বসতি তৈরি করা যায় সেজন্যে প্রতিনিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালে চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করেছেন। মূলত এই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে নিয়ে এগচ্ছে আমেরিকার একাধিক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। সম্প্রতি নাসার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে চন্দ্রপৃষ্ঠে যন্ত্রপাতি পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে তারা। ২০২৪ সালে মানুষ পাঠাতে যান পাঠাতেই এই উদ্যোগ। যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও পাঠাতে অ্যাস্ট্রোবোটিক, ইনটিউটিভ মেশিনস ও অরবিট বেয়ন্ড নামে তিনটি বেসরকারি সংস্থাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। নাসার চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জিম ব্রিডেনস্টাইন জানিয়েছেন, শুধু জাতীয় পতাকা পুঁতে আর মাটি তুলে এনেই কাজ শেষ হয়ে যাবে না চাঁদের মাটিতে নামা মার্কিন মহাকাশচারীদের। তাঁদের আরও অনেক রকমের জটিল কাজ করতে হবে চাঁদের মাটিতে নেমে। যাতে আগামী দিনে চাঁদে মানুষ পাঠানো যায়। সেখানেও গড়ে তোলা যায় মানুষের থাকার জায়গা। যাতে চাঁদকে ট্রান্সপোর্টেশন হাব হিসেবে গড়ে তুলে সেখান থেকে মঙ্গলের মতো ভিনগ্রহে পাঠানো যায় মহাকাশযান। তাতে ভিনগ্রহ অভিযানের সময় কমবে। কমবে জ্বালানির খরচও। ব্রিডেনস্টাইন এও জানিয়েছেন, ফের চাঁদের মাটিতে মহাকাশচারী নামানোর আগে মানুষ ছাড়াই একটি ল্যান্ডার ও রোভার পাঠাবে নাসা, ২০২৪ সাল নাগাদ বা তার কিছু আগে।