কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির তখন টালমাটাল অবস্থা। নাৎসি জার্মানির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে রাশিয়ার লালফৌজ আর আমেরিকান সেনারা। বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত খলনায়করা তখন তাদের অপকর্মের প্রমাণ লোপাটে ব্যস্ত। ৩০ এপ্রিল রেড আর্মি বার্লিনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। জার্মানির মিলিটারি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ওয়ার্নার ওসেনবার্গ রেডিওতে শুনতে পেলেন হিটলারের আত্মহত্যার সংবাদ। দ্রুত তিনি সামরিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলো টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে গা ঢাকা দিলেন। কাগজগুলো বেশিরভাগ চলে গেল ভূগর্ভস্থ নর্দমায়। কিন্তু সম্ভবত জল শেষ হয়ে যাওয়ায়, ফ্ল্যাশ হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু কাগজ উদ্ধার হওয়ার পর চলে গেল ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এর কাছে। হাতবদল হয়ে সেই কাগজ আবার পৌঁছে গেল আমেরিকান গোয়েন্দাদের কাছে। তখন এই কাগজে থাকা তথ্যগুলোই যে হন্যে হয়ে খুঁজছে মার্কিন গোয়েন্দারা। আর সেসব কাগজ থেকেই শুরু হয়েছিল গোপন এক অভিযান। যার নাম ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’। কী লেখা ছিল সেই কাগজে? কী ছিল সেই অভিযানে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের অধীনে নাৎসি জার্মানির উত্থানের পিছনে অনেক বড় ভূমিকা ছিল বিজ্ঞানীদের। তাই যুদ্ধকালীন জার্মানিতে থাকা বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী আর গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নীচে আনতেই গঠন করা হয় মিলিটারি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন। এর প্রধান করা হয় ওয়ার্নার ওসেনবার্গকে। ওসেনবার্গ সেইসময় হ্যানোভার টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। নাৎসিবাদের ভক্ত হিসাবে তাঁর বেশ খ্যাতি ছিল। তার কাঁধে দায়িত্ব ছিল সামরিক অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করতে সক্ষম এমন বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ আর প্রকৌশলীদের এই সংগঠনে নিয়োগ করা। তিনি তাঁর কাজে সফল ছিলেন বটে। এখানে তিনি কম করে হলেও প্রায় ৫,০০০ বিখ্যাত বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ আর প্রকৌশলী নিয়োগ করেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের নামের তালিকার একটি কপিই টয়লেটে ফ্ল্যাশ হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। পরবর্তীতে এই তালিকা মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে গিয়ে পড়ে। এই তালিকার ঐতিহাসিক নাম ‘ওসেনবার্গ লিস্ট’। আর এই লিস্ট ধরে জার্মানিতে থাকা মার্কিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা শুরু করেন বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করার কাজ।
খ্যাতিমান সেই বিজ্ঞানীদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার গোপন মিশন শুরু করেন তাঁরা। তাদের লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার সহ সামরিক যন্ত্রপাতিতে দক্ষ বিজ্ঞানীরা। পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সামরিক ডাক্তার, জৈব প্রযুক্তিবিদ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রের সেরাদের ধরে ধরে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার গোপন এই পরিকল্পনাই করা হয়েছিল ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’-এর অধীনে।
মার্কিন গোয়েন্দারা অপারেশন পেপারক্লিপের কাজ শুরু করেন অনেক আগেই। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সেক্রেটারি হেনরি ওয়ালেস নিয়মিত খবরাখবর রাখতেন জার্মানির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সামরিক গবেষণাগুলোর উপরে। বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষের দিকে তখন এই ওয়ালেস আঁচ করতে পেরেছিলেন আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্ভাব্য এক স্নায়ুযুদ্ধের কথা। আর কঠিন এই যুদ্ধে জিতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে গেলে বিজ্ঞানীদের যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে, তা ভালোই বুঝতেন দক্ষ অর্থনীতিবিদ আর পরবর্তীতে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া হেনরি ওয়ালেস।
তাই যুদ্ধের হাওয়া যখন মিত্রশক্তির দিকে বইছে, তখন প্রায় ১,৮০০ জার্মান বিজ্ঞানীর তালিকা করা হয়। তারা সবাই যুদ্ধকালীন রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক বোমা, সামরিক ওষুধপত্র, রাসায়নিক আর জৈব অস্ত্র নিয়ে কাজ করছিলেন। এই ক্ষেত্রগুলোতে নাৎসি জার্মানির বিজ্ঞানীরা অভূতপুর্ব সাফল্য পেয়েছে — এমন খবরও ছিল গোয়েন্দাদের কাছে। আর তাই এদের সকলকে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়ালেসের খসড়া তালিকাটি পৌঁছে দেওয়া হয় আমেরিকান সেনা, নৌ আর বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ একদল গোয়েন্দার কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে গঠিত এই গোয়েন্দা দলের কেতাবি নাম ‘United States Joint Intelligence Objectives Agency (JIOA)’। এই দলটিই মূলত ওসেনবার্গ লিস্টের সঙ্গে ওয়ালেসের খসড়াটির সমন্বয় করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। এই তালিকাটি ১৯৪৫ সালের মে মাস নাগাদ জার্মানিতে থাকা মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও ছিল দলটির। এই গোপন অপারেশনের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ওভারকাস্ট’। পরবর্তীতে মার্কিন সামরিক বাহিনী এর নামকরণ করে ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান বিজ্ঞানীরা যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, বিশেষত রকেট নির্মাণে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তা কারও অজানা ছিল না। নাৎসি বিজ্ঞানীদের নির্মিত ২,০০০ পাউন্ড ওজনের গোলাবারুদ বহনে সক্ষম V-2 rocket মিত্র বাহিনীর জন্য ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যু। আর তাই এই গোপন অপারেশনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, এই রকেট নির্মাতা বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করা। আর এই তালিকায় থাকা ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানী, যাঁদের আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তাঁদের কাগজপত্রগুলোকে ‘পেপারক্লিপ’ দিয়ে আলাদা করে রাখতেন গোয়েন্দারা। আর তাই ১৯৪৫-এর নভেম্বরে আমেরিকার সামরিকদপ্তর থেকে এই মিশনের নাম রাখা হয় ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’।
১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের শুরুর দিকে আর্মি অর্ডিন্যান্সের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের রকেট শাখার প্রধান কর্নেল টফটয় জার্মান রকেট বিজ্ঞানীদের প্রাথমিকভাবে এক বছরের একটি চুক্তির প্রস্তাব দেন। টফটয় ওই বিজ্ঞানীদের পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দিলে মোট ১২৭ জন বিজ্ঞানী তাঁর প্রস্তাবটি মেনে নেন। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৭ জন বিজ্ঞানীর প্রথম দল জার্মানি থেকে আমেরিকায় পৌঁছান। পরবর্তীতে তাঁদের টেক্সাসে নিয়ে আসা হয় ‘War Department Special Employee’ হিসেবে। এর প্রায় এক দশক পর এই জার্মান বিজ্ঞানীরা যুদ্ধের সময় কোথায় কী কাজে লিপ্ত ছিলেন, সেই বিষয়ে খোজ খবর নেওয়া শুরু হয়। তাঁদের মধ্যে আর্থার রুডলফ দাস শ্রমিক ক্যাম্প, হিউবার্টাস স্ট্রাগহোল্ড মানব পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানের উন্নতিতেও।
ওসেনবার্গ লিস্টের এক নম্বরে ছিলেন রকেট সাইন্টিস্ট ওয়ার্নার ভন ব্রাউন। যুদ্ধ শুরুর আগে প্রতিভাবান এই বিজ্ঞানীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মহাকাশে মনুষ্যবাহী রকেট পাঠানো। কিন্তু অভিজাত এই জার্মান বিজ্ঞানী শুরু থেকেই ছিলেন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সমর্থক। হিটলার তাকে মিলিটারি স্পেস রিসার্চের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করার পর তার হাতেই তৈরি হয় ইংল্যান্ডে আঘাত হানা সেই কুখ্যাত V-2 rocket। অপারেশন পেপারক্লিপের মাধ্যমে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয় বিজ্ঞানী ব্রাউন আর দলের সব ইঞ্জিনিয়ারকে। ১০৪ জন রকেট সায়েন্টিস্টের পুরো দলকে মার্কিন সেনাবাহিনী নিয়োজিত করে মহাকাশ গবেষণার কাজে। মার্কিন সরকার এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁদের নিশ্চিত করা হয় কড়া নিরাপত্তা। মহাকাশে মার্কিনীদের পাঠানো প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘এক্সপ্লোরার-১’ উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে অ্যাপোলো মিশনে অনেক বড় ভূমিকা রাখেন এই দলের সদস্যরা। অ্যাপোলো-১১ মিশনের সহকারী পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন ওয়ার্নার ভন ব্রাউন।
‘অপারেশন পেপারক্লিপ’-এর তালিকায় ছিলেন অটো অ্যামব্রোস-এর মতো খ্যাতনামা রসায়নবিদরাও। অটো অ্যামব্রোস ছিলেন ‘সারিন’, ‘ট্যাবুন’ সহ বেশ কয়েকটি নার্ভ গ্যাসের উদ্ভাবক। যুদ্ধের ট্যাঙ্ক সহ যুদ্ধযানের টায়ার নির্মাণে অ্যামব্রোস গবেষণাগারে তৈরি করেন কৃত্রিম রাবার। ১৯৪৪ সালে হিটলার তাঁকে এক ভোজসভায় ডেকে ১০ লক্ষ রাইখমার্ক দিয়ে পুরস্কৃত করেন। কিন্তু, পেপারক্লিপের খপ্পরে পড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানো এই বিজ্ঞানী পরবর্তীতে কাজ করেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য। ভন ব্রাউন আর অটো অ্যামব্রোসের মতো আরও প্রায় ১,৬০০ জার্মান বিজ্ঞানী এই অপারেশনের মাধ্যমে আমেরিকায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের সবাই আমেরিকায় সামরিক বাহিনীর গবেষণা ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বীকৃতি রেখেছেন। তাই অপারেশন পেপারক্লিপ যে মার্কিন শিবিরে অনেকগুণ সফল ছিল তা বলাই বাহুল্য। যা পরবর্তীতে আমেরিকাকে বিশ্বের শক্তিশালী দেশ হিসেবে তুলে এনেছে।
আমেরিকার এই তৎপরতার খবর পেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এমন ভাবা মুর্খামি। সোভিয়েত গোয়েন্দা আর সামরিক বাহিনীও শুরু করে অপারেশন ওসোভিয়াখিম। যার মাধ্যমে যুদ্ধকালীন ২,০০০ জার্মান বিজ্ঞানীকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার এই অপারেশনে জার্মান বিজ্ঞানীরাও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁদের জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাতে হবে এই দুই দেশের যেকোনও একটিতে। ওই সময়ে যে সব বিজ্ঞানী ও গবেষকরা সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন, তাঁরাও অনেক বেশি অবাক হয়েছিলেন। কারণ, তাদের সেখানে ভালো ভালো চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমনকী তাদের স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। যার ফলে সেখানে একটি ছোটখাটো জার্মান কলোনি গড়ে ওঠে। শুধুমাত্র কাজের ক্ষেত্র ছাড়া জার্মান বিজ্ঞানীদের রাশিয়ান লোকদের থেকে আলাদা করেই রাখা হতো এবং রাশিয়ার লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করার অনুমতি তাদের ছিল না। ১৯৫২ সালের দিকে যখন রাশিয়ায় তাদের নিজেদের বিজ্ঞানীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজগুলোতে জার্মান বিজ্ঞানীদের কদর কমতে থাকে। বিশেষ করে শিক্ষকতায়। এমনকী এক বছরের মাথায় জার্মান বিজ্ঞানীদের পূর্ব জার্মানিতে ফেরত পাঠানো হয়। হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন চায়নি তাদের বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের কৃতিত্ব এমন কারও ঝুলিতে যাক যে কি না রাশিয়ান নয়।
এখনও পর্যন্ত এই মিশনের বেশিরভাগই গোপন করে রেখেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যতটুকু জানা যায়, তা ‘Operation Paperclip: The Secret Intelligence Program That Brought Nazi Scientists to America’ নামে ২০১৪ সালে লেখা একটি বই থেকে। লেখক মার্কিন সাংবাদিক অ্যানি জ্যাকবসেন।