বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়া সেই জোয়াকিন আর্চিভালদো গুজম্যান লোরাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে নিউ ইয়র্কের এক আদালত। মেক্সিকোর নাগরিক গুজম্যানকে এল চ্যাপো নামেই বিশ্ব চেনে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি তো বটেই আমেরিকাতেও ছড়ানো ছিল তাঁর মাদক চক্রের জাল। ২০১৪ সালের গ্রেপ্তারের আগে পর্যন্ত আমেরিকায় পাচার করেছিল ৫০০ টনের বেশি কোকেন। ৬১ বছরের এল চ্যাপোর বিরুদ্ধে দশ দফা অভিযোগ আনে মার্কিন পুলিস। প্রত্যেকটিতেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে কোর্ট। বিশ্বের একটা বড় অংশে মাদক চক্র চালানো, পাচার তো বটেই, খুন, ঘুষ নেওয়া, অস্ত্র কারবার, জেল ভাঙার মতো অপরাধও রয়েছে তালিকায়। ২৫ জুন তার সাজা ঘোষণা। আদালতের একটি সূত্র জানায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সম্ভাবনাই সব চেয়ে বেশি।
কে এই ‘এল চ্যাপো’? এল চ্যাপো-র অর্থ বামন। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির গুজম্যান সকলের কাছে বামন মানুষ নামেই পরিচিত। জন্ম মেক্সিকোর সিনেলোয়া শহরের ছোট্ট গ্রাম লা তুনাতে। ঠিক কবে তার জন্ম এ বিষয়ে কোনও তথ্য মেলেনি। কেউ বলে ১৯৫৪-র ২৫ ডিসেম্বর, আবার কেউ বলে ১৯৫৭-র ৪ জুলাই। আফিম চাষি বাবা এমিলিও গুজম্যান আর মা মারিয়া পেরেজের ১০ সন্তানের মধ্যে এল চ্যাপো ছিল চতুর্থ। যদিও কৈশোর পার হওয়ার আগেই তার বড় তিন ভাই মারা যায়। ছোটবেলাটা খুব সুখের ছিল না। সংসারের অভাবের কারণে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতে হতো। বাবা ছিলেন নেশাগ্রস্ত। প্রায়ই মারতেন। ১৫ বছর বয়সে বাবা বের করে দিলেন বাড়ি থেকে। ঠাঁই মিলল দাদির কাছে। খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে নিজেই আফিম চাষ করা শুরু করল। কিন্তু মন ভরছিল না। গ্রামের সবাই আফিম চাষ করে। যুগের পর যুগ তাই করে আসছে। বড় কোনও স্বপ্ন নেই কারও। নেই কোনও উচ্চাশা। ২০ বছর বয়সে ঘর ছাড়ল। যোগ দিল কাকা পেদরো এভলিস পেরেজের সঙ্গে। কাকা ছিল সেই সময়ের শীর্ষ মাদক পাচারকারীদের একজন। অপরাধ জগতের সঙ্গে পরিচয়টা ওখানেই। পরবর্তী কালে বিশ্বের এক নম্বর মাদক মাফিয়া হয়ে ওঠার কাহিনীটা অনেকটা হলিউডের ছবির মতো।
১৯৮০-র দশকে মেক্সিকোর মাদক ব্যবসা পরিচালনা করত ‘গুয়াদালাজারা কার্টেল’। যার নেতৃত্ব দিত মাগুয়েল আঞ্জেল ফেলিক্স। ৭০-র দশকে গুজম্যান প্রথম কাজ শুরু করে হেক্টর ‘এল গুয়েরো’ পালমার অধীনে। তার কাজ ছিল মাদক পরিবাহী জাহাজগুলোর হিসাব রাখা। উচ্চাভিলাষী গুজম্যান শৃঙ্খলার ব্যাপারে বরাবর কড়া ছিল। কোনও পাচারকারী সরবরাহে দেরি করলে নিজেই তার মাথায় গুলি করে দিত। গডফাদার মাগুয়েল আঞ্জেল ফেলিক্সের নেক নজরে পরে গেল এভাবেই। একসময় গডফাদারের সহকারী হয়ে গেল। পুরো মাদক সরবরাহ চলতে লাগল তার নেতৃত্বেই। আশির দশকে প্রচুর পরিমাণে কোকেন সরবরাহ হতো আমেরিকাতে। এই কারণে আমেরিকা উঠে পড়ে লাগে মাদক সম্রাটদের ধরতে। অনেক মার্কিন এজেন্ট ছদ্মবেশ নিয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে মিলে যান। এমনই একজন এজেন্ট ইনরিকে কামারেনা সালাজার। ছদ্মবেশে মাদক সাম্রাজ্যের বহু ভিতরে প্রবেশ করেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গুয়াদালাজারা কার্টেলের মারিজুয়ানা উৎপাদনের প্রধান উৎস ‘রাঞ্চো বুফালো’ মার্কিন সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয় এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেইমানির কারণে সালাজারের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয় এবং নির্মমভাবে খুন করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে আমেরিকা ফুঁসে ওঠে। মাদক সাম্রাজ্য পুরো নিঃশেষ করে দেওয়ার লক্ষ্যে নামে তারা। মাদকের সঙ্গে সম্পর্কিত সবাইকে গ্রেপ্তার কিংবা হত্যা করে। এই সময় গডফাদার মাগুয়েলও ধরা পড়েন পুলিসের কাছে। তার অবর্তমানে সাম্রাজ্য চালাতে শুরু করে গুজম্যান এবং ইসমায়েল ‘এল মায়ো’ জামবাদা, মাগুয়েলের দুই সহকারী। ১৯৮৯-র দিকে যখন গুজম্যান নিজস্ব ‘সিনেলোয়া কার্টেল’ চালাচ্ছিল, এই সময়ই সে টানেলের মাধ্যমে মাদক পাচারে নতুন পথ খুলে ফেলে।
গুয়াদালাজারা ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচারে সদ্য পাশ করা ফিলিপ ডি জিসুস করোনার সাহায্যে আগুয়া পিতা থেকে আমেরিকার অ্যারিজোনা, ডগলাস পর্যন্ত এক লম্বা টানেল তৈরি করে গুজম্যান। এই টানেলের সাহায্যে গুজম্যান এত দ্রুত মারিজুয়ানা পাচার করতে পারত যে, তার ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ‘এল রাপিদো’ (দ্রুত মানব)। ‘সিনেলোয়া কার্টেল’ চালু করার পর গুজম্যান ‘গুয়াদালাজারা কার্টেল’ ফেলিক্স ভ্রাতৃদ্বয়ের হাতে তুলে দেয়। কিছু ভুল বোঝাবুঝির মীমাংসা করতে গুজম্যান ফেলিক্স ভ্রাতৃদ্বয়ের কাছে পাঠায় তার খুবই কাছের মানুষ আরমানদো লোপেজকে। রাগের মাথায় আরমানদোকে খুন করে রামোন ফেলিক্স। এর কয়েকদিন পরই, হেক্টর পামলার বৌ এবং দুই সন্তানকে হত্যা করে ফেলিক্স ভ্রাতৃদ্বয়। ফুঁসে ওঠে গুজম্যান। পামলার সঙ্গে জোট বেঁধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরই আরেলানো ফেলিক্স অর্গানাইজেশন (এএফও) গুয়াদালাজারা এয়ারপোর্টে গুজম্যানকে হত্যার চেষ্টা করে। দু’পক্ষের মাঝখানে ১৪ গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের কার্ডিনাল জুয়ান জিসুস পোসোডাস। এই ঘটনার পর গুজম্যান গুয়েতামালায় পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যায়। মেক্সিকোতে ফিরিয়ে নিয়ে এসে তাঁকে পুন্তে গ্রানাদে জেলখানায় রাখা হয়। ২০০১ সালে মেক্সিকো প্রশাসন যখন তাকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এমন সময় জেল কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে গুজম্যানের জীবন শুধু দৌড় আর দৌড়। ঘন ঘন তাকে জা্য়গা পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু সব সময় সিনেলোয়া, দুরাঙ্গ এবং চিহুয়াহুয়ার ভিতরে থাকত। এই ত্রিভুজ আকৃতির অঞ্চলটা ‘সিনেলোয়া কার্টেল’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এই সময়ে একের পর এক খুন, নির্বাসন, কারাদণ্ডে জর্জরিত গুয়াদালাজারা কার্টেল প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। হঠাৎ করেই মিত্র জুয়ারেজ কার্টেলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে সিনেলোয়া কার্টেলের। জুয়ারেজ কার্টেল সম্রাট চুদাদ জুয়ারেজ গুজম্যানের নেতৃত্ব ভাল চোখে দেখেনি। এর ফলেই দ্বন্দ্বের শুরু। কিন্তু সিনেলোয়া কার্টেলের বিশাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বেশিদিন টিকতে পারেনি জুয়ারেজ কার্টেল। খুন, পাল্টা খুনে পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়। একের পর এক কার্টেলের বিরুদ্ধে জয়ে গুজম্যান যেন ক্ষমতা-অন্ধ হয়ে গেল। মিত্র-শত্রু কাউকেই পাত্তা দিত না। বেলট্রান লেইভা অর্গানাইজেশন (বিএলও), যারা গুয়াদালাজারা কার্টেল, জুয়ারেজ কার্টেলের সঙ্গে যুদ্ধের সময় গুজম্যানের সঙ্গে ছিল, যাদের মাধ্যমে গুজম্যান পুলিস এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহায়তা পেত, এক সময় তাদের সঙ্গেই বেইমানি করে। হত্যালীলা চালিয়ে গুজম্যান এই অর্গানাইজেশনও শেষ করে দেয়।
গুজম্যান তার গোল্ডেন ট্রায়েঙ্গেলের ভিতর সুরক্ষিত ছিল। তারপরও মিলিটারি সদস্যরা তাঁকে ধরার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খবর পাওয়া যায়, পারিবারিক পুনর্মিলনীর উদ্দেশ্যে গুজম্যানকে সিনেলোয়াতে দেখা যাবে। গুপ্তচররা তার দেহরক্ষীকে অনুসরণ করে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছলেও সুরক্ষিত দরজার কারণে গুজম্যান পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি, বেলা ৬.৪০-র দিকে, ইউএস মেরিন এবং আমেরিকার মাদক বিরোধী এজেন্টরা মাজাতলানের এক হোটেল থেকে গুজম্যানকে গ্রেপ্তার করে। এবার রাখা হয় আতিপালানো জেলখানার সুরক্ষিত সেলে। ২৪ ঘণ্টা নজরবন্দিতে। বিচারের রায় দেওয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। সেই সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, গুজম্যানকে সব পাপের শাস্তি দিতে গেলে ৩০০-৪০০ বছরের কারাদণ্ড দিতে হবে। কিন্তু রায় শোনার অপেক্ষায় বসে ছিল না গুজম্যান। ২০১৫-এর জুলাইয়ের কোনও এক সন্ধ্যায় কারাগারের বাথরুমের মেঝেতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে যায়। এমনই সুড়ঙ্গ, যা কি না ছিল এক মাইলেরও বেশি লম্বা!
এবার গা ঝাড়া দিয়ে মাঠে নামে সবাই। ইউএস মেরিন, মাদক-বিরোধী এজেন্টরা, মেক্সিকান পুলিস, মিলিটারি। তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। গ্রামের পর গ্রাম ঘেরাও করে তল্লাশি চালানো হল। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও গুজম্যান তার সাম্রাজ্য চালাতে থাকে। ক্রিসমাসে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ছবিও প্রকাশ করে। কিন্তু একটা সাক্ষাৎকার সব শেষ করে দেয়। ঘন জঙ্গলের মধ্যে অত্যন্ত গোপনে সারা হয়েছিল যেটা। কিন্তু শেষমেশ তারই খেসারত দিতে হয়েছে গুজম্যান ওরফে ‘এল চ্যাপো’-কে। দীর্ঘ ছ’মাস ধরে গোটা মেক্সিকোর সেনা-পুলিসের চোখে ধুলো দেওয়ার পরে অবশেষে ফের ধরা পড়ে সে। ৮ জানুয়ারি, ২০১৬। কিন্তু ওই সাক্ষাৎকারটা না-দিলে হয়তো এমনটা সম্ভবই হতো না। আর সেটা মেনে নিয়েছে মেক্সিকো প্রশাসনও। কারণ ওই সাক্ষাৎকারের ভিডিওর বিভিন্ন অংশই নাকি ছিল গোয়েন্দাদের কাছে সবচেয়ে বড় ‘ক্লু’। সিনেলোয়ার বাইরে ছোট শহর লস মচিসে পুলিসের হাতে ধরা পড়ার পর আবার নিয়ে আসা হয় আতিপালানোতে। বিচারকাজ শুরু হয়। এবার নজরবন্দির দায়িত্বে ৭৫ জন এজেন্ট। কারাগার পাহারায় ৬০০’র বেশি সেনা। আগের দু’বার পালাতে যারা সাহায্য করেছে তাদের বিচার হল খুব দ্রুতই এবং কঠোর শাস্তিই দেওয়া হল। অনেক আইনি জটিলতার পরে তাকে আমেরিকায় প্রত্যর্পণ করানো হয়। তিন মাসের বিচার প্রক্রিয়ায় ৫৬ জন মাদক মাফিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ১৪ জন ছিলেন তাঁরই এক সময়ের ছায়াসঙ্গী। রায় শোনার পরে এল চ্যাপোর আইনজীবীরা স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁদের মক্কেলের বিরুদ্ধে এত প্রমাণ ছিল যে তাঁদের যুক্তি আদালতে ধোপে টেঁকেনি। রায় ঘোষণার সময়ে আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন মাদক মাফিয়ার বর্তমান স্ত্রীও।
গুজম্যান জেলে, আর এই সময়ে সিনেলোয়া কার্টেল নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত তার তিন ছেলে এবং ভাই এরিলিয়ানো গুজম্যান। অন্য কার্টেল থেকেও হুমকি আসছে। বেশি দিন আগের কথা নয়, ‘জালিস্কো কার্টেল’ গুজম্যানের দুই ছেলেকে অপহরণ করে এক রেস্টুরেন্ট থেকে। যদিও ক’দিন পরেই অক্ষত অবস্থায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সিনেলোয়া এখনও মেক্সিকান ড্রাগ উৎপাদনের কেন্দ্র। নতুন নতুন কার্টেলের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু দখল করতে পারছে না কেউই। সবাই বিশ্বাস করে, কোনও না কোনও একদিন আবার জেল থেকে পালাবে গুজম্যান। আবার হাজির হবে সিনেলোয়া শহরের রাজধানী কুলিয়াকানে। আবার রাজত্ব করবে নিজের সাম্রাজ্য। ‘এল চ্যাপো’-কে আটকে রাখা নাকি কঠিন!