জীবানন্দ বসু, কলকাতা: দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাম দলগুলি ইদানীং নিজেদের মধ্যে ঐক্য আরও সুদৃঢ় করার তাগিদ অনুভব করছে। জাতীয় স্তরে বিজেপি এবং রাজ্য পর্যায়ে গেরুয়া শিবিরের পাশাপাশি তৃণমূলের মতো দক্ষিণপন্থী আঞ্চলিক দলের মোকাবিলা করে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতেই এই ঐক্য এখন জরুরি হয়ে পড়েছে লালপার্টিতে। বাম দলগুলির নেতৃত্ব এনিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরেই যৌথ আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যের কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে এসবের মধ্যেই বাম শিবিরে সবচেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে সিপিএম এবং সিপিআইয়ের পারস্পরিক সমঝোতাকে আরও মজবুত করার বিষয়ে। দেশের আদি কমিউনিস্ট পার্টি তথা সিপিআই এবং তা ভেঙে জন্ম নেওয়া সিপিএমের নেতৃত্ব কি পরিস্থিতির চাহিদায় ফের একটি দলে পরিণত হতে চলেছে—বাম রাজনৈতিক মহলে ধীরে হলেও সেই জল্পনা উঁকি দিতে শুরু করেছে। তবে বিষয়টি এখনও কোনও পক্ষই খোলসা করেনি। ফলে সবটাই জল্পনার স্তরে রয়ে গিয়েছে। দু’দলের নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে এখনও যেভাবে পারস্পরিক ইগো বিরাজ করছে, তাতে এই উদ্যোগ শেষমেশ ‘সোনার পাথরবাটি’ হিসেবেই থেকে যাবে কি না, তা নিয়েও চর্চায় ব্যস্ত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
ঠিক কী কারণে এই দুই কমিউনিস্ট পার্টির এক হয়ে চলার কথা বাম রাজনৈতিক মহলে মাথাচাড়া দিয়েছে? দু’দলের নেতৃত্বের সূত্রে যা জানা গিয়েছে, তাতে এই চর্চার সূত্রপাত হয়েছে দিন কয়েক আগে দিল্লিতে বিশিষ্ট সিপিআই নেতা তথা দেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে দুই সাধারণ সম্পাদকের একান্ত কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি এবং সিপিআইয়ের ডি রাজা ওইদিন এনিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করেছেন। দু’দলের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব দূর করে একসঙ্গে পথ চলার জন্য উভয় নেতৃত্বই মুখোমুখি আলোচনার পক্ষপাতী। এমনকী, এজন্য দু’দলের পাঁচজন করে শীর্ষস্থানীয় নেতাকে নিয়ে একটি টিম করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। তবে সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী এবং সিপিএমের পলিটব্যুরোয় ওই নেতাদের নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি। দু’দলের সূত্র বলছে, কোনও পূর্ব শর্ত ছাড়াই এনিয়ে কথা বলার ব্যাপারে ঐক্যমত হয়েছেন ইয়েচুরি-রাজা।
জানা গিয়েছে, এই উদ্যোগের ব্যাপারে সিপিআইয়ের তরফে আগ্রহ কিছুটা হলেও বেশি। সদ্য অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনের পর ‘ইউনিফিকেশন অব টু কমিউনিস্ট পার্টি’ অর্থাৎ, দুই কমিউনিস্ট পার্টির সংযুক্তিকরণের ব্যাপারে সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে এক দফা আলোচনা হয়েছে। সমস্ত ইগো ঝেড়ে ফেলে এনিয়ে সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা শুরু হওয়া দরকার বলে সিপিআইয়ের ওই অংশটি দাবি তোলে। পূর্বতন সাধারণ সম্পাদক সুধাকর রেড্ডির উপস্থিতিতেই এই দাবিতে সরব হন বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তবে রেড্ডি সেই সময় এনিয়ে ইয়েচুরিকে আলোচনার কোনও প্রস্তাব দেননি। সেই কাজ এবার করলেন রাজা। তবে দু’দলের অনেক নেতাই বলছেন, গত শতাব্দীর নয়ের দশকে এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন দুই মার্কসবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক এবি বর্ধন ও হরকিষেণ সিং সুরজিৎ। কিন্তু সংযুক্ত দলের লেটারহেডে কোন দলের নাম আগে থাকবে, তা নিয়েই বিতর্ক চলে। শেষ পর্যন্ত দু’-এক দফা কথাবার্তার পর এনিয়ে কোনওপক্ষই আর এগয়নি। তারপর প্রায় বছর পঁচিশ বাদে ফের এমন উদ্যোগ নিয়েছেন রাজা এবং ইয়েচুরি। তবে শেষ পর্যন্ত তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যাচ্ছে। তবে উভয়পক্ষের কাছে আশার কথা একটাই—পঁচিশ বছর পর নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি এবং প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ায় এবার তাগিদের স্বরূপ ভিন্ন।