সমৃদ্ধ দত্ত, সুরাত, ২২ এপ্রিল: ৫০০ স্কোয়ার ফুট ঘরে এই ধরুন ২৫ জনকে থাকতেই হয়। না হলে তো ভাড়া বেশি লাগবে! প্রত্যেকের মাথার কাছে একটা করে ব্যাগ। ওটাই সংসার। আর ঘরে একঝাঁক দড়ি লাগানো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তাতে গামছা, জামা, প্যান্ট ঝুলছে। যে যেখানে শুয়ে আছেন, তার মাথার উপরের দড়ির অংশটি তাঁর এলাকা। ঘরের দু’প্রান্তে দু’টি ফ্যান চলছে। তাতে হাওয়া যত, তার থেকে বেশি জমে থাকা ধুলো, ময়লা, ঝুল। সঙ্গে ঘড়ঘড় শব্দ। এর নাম মেস। কোথাও নাম মহাবীর মেস, কোথাও মহল্লা বাড়ি মেস, কোনওটার নাম ভোলাগিরি মেস। ওড়িশার গঞ্জাম, বাংলার হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, বিহারের কাটিহার, দ্বারভাঙ্গা থেকে আসা শ্রমিকের দল সুরাতের ট্রেনে চাপে তিনটি জায়গায় কাজ করতে... পাওয়ারলুম, জরি কারখানা আর সিল্কের এমব্রয়ডারি। মেস নামক এই ঘরগুলির কোনও জানালা থাকে না। দেওয়ালে ড্যাম্প। ঘর সারানো হয় না কোনওদিনই। ঠিক যেভাবে কোনও পাওয়ারলুম মেশিনও সারানো হয় না। সার্ভিসিং না হওয়া মেশিনে কাজ করতে করতে নিয়ম করে আঙুল কেটে যাবে। কোনও সময় বাদও চলে যেতে পারে। সে ঘটনা ঘটেছে আকছার। আর মেশিনের মধ্যে যখন ভালো করে সুতোটা ঢুকছে না, তখন হাত দিয়ে ঢোকানোর সময় ইলেকট্রিক শক লাগবে। একদিন... দু’দিন... তিনদিন... ইলেকট্রিক শকের পর অভ্যাস হয়ে যায়। তবে সেই মেশিন প্রত্যেকবার একই পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে... তা তো হয় না! তাই কখনও সখনও এতটাই বেশি শক লাগবে যে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। নিয়ম অনুযায়ী একটা পুলিশ কেস হবে। কিন্তু সেটা বেশিদিন চলবে না। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড ২ লক্ষ টাকা লেবারের পরিবারকে আর ৫০ হাজার টাকা পুলিসকে দিয়ে সেইসব পাওয়ারলুম মালিকদের গাফিলতির অপরাধ সংবলিত কেস বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর যদি এসব থেকে কেউ বেঁচেও যায়, তাহলে কয়েক বছর পর হবে টিবি। বললেন সুভাষ গোলদার। হাওড়ার ডোমজুড় থেকে এসেছিলেন জরির কাজে। কিন্তু জরির তুলনায় তবুও পাওয়ারলুম মেশিনে তাৎক্ষণিক পেমেন্ট পাওয়া যায়। তাই কাজ শিফট করেছেন। শুধু ফারাক হল, জরিতে টাকা পাওয়ার কোনও তারিখের ঠিক নেই, তবে আর কোনও রিস্ক থাকে না। পাওয়ারলুমে সপ্তাহের শুক্রবার পেমেন্ট হবেই, কিন্তু প্রাণের রিস্ক থেকে যায়। কারণ, এখানে কেউ নতুন মেশিন বসায় না। পুরনো দিয়ে কাজ চালায়। মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের সন্তোষ মণ্ডল এখনও জরি শিল্পে জড়িয়ে আছেন। উত্তর সুরাতের ফুলওয়াদির এমব্রয়ডারি ইউনিটে কাজ করেন। বাড়ি যান কতদিন পরপর? উৎসবে, পরবে যেতে পারেন তো? সন্তোষ মণ্ডল হাসলেন..., ‘একটা রিস্ক আছে। ফিরে এসে যদি কাজ না থাকে! এখানে তো কোনও কন্ট্রাক্ট নেই! যেভাবে ছাঁটাই হচ্ছে, একবার যদি এসে দেখি কাজটা আর ফিরে পেলাম না, তাহলে তো খুব বিপদে পড়ব।’
এই বছরভর ঘর ছেড়ে বাইরে আসা বাঙালি মজুরের দল ভোট দিতে অবশ্যই যাচ্ছেন। তিনদিনের ছুটিতে। কাকে ভোট দেবেন? কুমার পাল, পলাশ মাইতিরা স্পষ্ট বললেন দিদিকে। আপনাদের তো ওখানে কাজ জুটছে না। সারা বছর ঘরের বাইরে থাকতে হচ্ছে। তাও দিদিকে দেবেন? অবশ্যই। কন্যাশ্রী, গীতাঞ্জলি আর শিক্ষাশ্রী, শিশুসাথীর স্কিমে আমাদের মতো গরিবদের যে কতটা উপকার হয়েছে, আপনারা ঠিক বুঝতে পারবেন না। এখন জানেন তো, এখানে পেমেন্ট দেরিতে পেলেও কোনও টেনশন হয় না। কারণ আগের মতো ওরকম সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা বাড়িতে না পাঠালেও চলে গীতাঞ্জলীতে তো বাড়ি করার জন্য ৭০ হাজার টাকাও পেয়েছি। বললেন, পলাশ। তাই ভোট দিদিকেই। মোদির রাজ্যে বসে দিদির জয়গান গাওয়া পলাশ বললেন, ‘গ্রাম-গঞ্জ কিন্তু অনেক পেয়েছে দাদা। খোঁজ নিয়ে দেখবেন।’