গুঞ্জন ঘোষ, কলকাতা: পুজোয় বাংলা গান নিয়ে বাঙালির মাতামাতির দিন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। বাংলা গানের স্বর্ণযুগ এখন স্মৃতির পাতায়। এখন কেউ ভরসা করে আধুনিক গান করেন না। সিডির দিনকাল অস্তমিত। বিগত কয়েক বছর আগে পুজোয় অ্যালবাম বেরত। এখন তাতেও ভাটার টান। প্রথম কারণ প্রযুক্তিগত। অ্যালবামের চেয়ে এখন বেশি বেরয় সিঙ্গলস। আট/দশটা গান গাওয়ার ট্রেন্ড কমে আসছে। ইউটিউব এখন যোগাযোগের শক্তিশালী মাধ্যম। একটা গান ইউটিউবে আপলোড করতে পারলে প্রচুর ভিউয়ার্স মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যায়। তাই শুধু পুজো বলে নয়, সারা বছরই ইউটিউবে গান বেরয়। আসলে এখন মোবাইলেই সবকিছু হাজির। তাহলে প্রযুক্তির কাছে কি হারিয়ে যাবে বাঙালির গান শোনার স্মৃতিবাহী ঐতিহ্য?
বাংলা গানে নতুন প্রজন্মের ভাবনা-চিন্তার প্রকাশ ঘটছে যেমন, তেমনই বাংলা গানকে একাই প্রায় ধরে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এবার পুজোয় লোকসঙ্গীত, অল্প কিছু আধুনিক, আগমনি গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হচ্ছে।
ভাবনা রেকর্ডস অ্যান্ড ক্যাসেটস-এর কর্ণধার বিশ্ব রায় জানালেন, এখন সিডি বিক্রি আগের মতো নেই এ কথা ঠিকই, আবার এটাও ঠিক, বাংলা গান বাঁচাতে হলে সিডির বিকল্পও নেই। সিডি না থাকলে রেডিও, এফএম চ্যানেলগুলো কী বাজাবে? তাই অ্যালবাম করতেই হবে। যতদিন পারব বাংলা গানের সিডি বের করবই। ভাবনা সবসময় একটু অন্যরকম কাজ করে। রবীন্দ্রনাথ ২২শো পুরুষকে চিঠি লিখেছিলেন। তার মধ্যে থেকে দেড়শো চিঠি নিয়ে একটি অ্যালবাম থাকছে। চিঠিগুলি পাঠ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আরও একটি অভিনব অ্যালবাম ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’ বেরচ্ছে। গান ও পাঠে চন্দ্রাবলী রুদ্র দত্ত।
আশা অডিওর কর্ণধার মহুয়া লাহিড়ীও স্বীকার করলেন, আগের মতো পুজোর গানের ট্রেন্ড আর নেই। পুজোর গানও সেভাবে হচ্ছে না, সিডিও বের হচ্ছে না। এখন গান মানেই সিঙ্গলস। আশা অডিও থেকে এবারও বেরচ্ছে আগমনি গান, কুমার শানুর অ্যালবাম ‘আমার দুর্গা মা’। শানুরই ছ’টি আধুনিক গানের অ্যালবাম ‘খেয়ালি দিন’, সুর দিয়েছেন শোভন গাঙ্গুলি, কিঞ্জল ও অঙ্কন। তালিকায় রয়েছে দোহারের কালিকাপ্রসাদের শেষ গান ‘হাসনরাজার গান’। শান এই প্রথম বাংলা গানে সুর করেছেন ‘সুপার সিঙ্গার জুনিয়র’। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা গান গেয়েছেন এই অ্যালবামে। থাকছে জয়তী চক্রবর্তীর লোকগানের অ্যালবাম ‘বনমালি’। এছাড়া দুর্নিবার ও বৃষ্টিলেখার সিঙ্গলস ভিডিও আধুনিক রোমান্টিক গান বেরচ্ছে এই সংস্থা থেকে।
কৃষ্টি ক্রিয়েশন-এর ডিরেক্টর শ্বেতা গুপ্তর অভিমত একই। তিনি বললেন, ‘এখন অ্যালবাম রিলিজ বলা হয় না, বলা হয় গান রিলিজ। একসঙ্গে অনেক গান গাওয়ার রেওয়াজটা কমে আসছে। তাই সিঙ্গলস-এর কদর বাড়ছে। এখন সিডির দোকান হাতের মুঠোয় মানে মোবাইলে। কম সময়ে বিনোদন কে না চায়! আমাদেরও এই মাধ্যমে আগমনি, রবীন্দ্র-নজরুল- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান বেরচ্ছে। প্রবীণ রামানুজ দাশগুপ্ত এবার দারুণ একটি কাজ করছেন। ফিরোজা বেগমের ভাইঝি বাংলাদেশের শিল্পী সুস্মিতা আনিসের অ্যালবাম ‘চেনা শহর’ সমস্ত অনলাইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হয়েছে।
একটু অন্যরকম কথা শোনা গেল রাগা মিউজিকের কর্ণধার প্রেম গুপ্তার কণ্ঠে। তিনি বললেন, যে যাই বলুক, আমাদের কাছে বাংলা আধুনিক গানের চাহিদা আছে। এ পর্যন্ত শ্রোতারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন কুমার শানু ও শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধুনিক গানের অ্যালবাম ‘মিলনে বিরহে’ নিয়ে। তবে এটা ঠিক, আগের মতো পুজোর গান নিয়ে মাতামাতি নেই। আমরা সিডির পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও অনেক সিঙ্গলস আনছি।
মিউজিক ২০০০-এর কর্ণধার স্বরূপ পাল জানালেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সাধারণের হাতে এসে যাওয়ায় গানের বাজারে খারাপ সময় আসছে। বিভিন্ন সিডি কোম্পানির গুরুত্ব কমছে দ্রুত। কলকাতায় সিডি বিক্রির দোকান মাত্র দু’-তিনটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য সবার মতো আমরাও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনেক গান রিলিজ করছি। এই সংস্থাও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের শরণাপন্ন হয়েছে। বেরচ্ছে একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতির সঙ্কলন। নতুনদের একটা করে সিঙ্গলস বেরচ্ছে। টেপ রেকর্ডার এসে হারিয়ে দিয়েছিল কলের গান গ্রামাফোনকে। এবার কি সিডির বিনাশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে?