বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
একথা যে কতজনকে, কতবার বলতে হয়েছে তাঁকে, তার ইয়ত্তা নেই। লড়াইটা আসলে ১৩ বছরের। চার-চারবার ক্যান্সার কেড়ে নিতে চেয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা এই বর্ষীয়ান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকে। একসময় কেমোথেরাপি নিতে নিতে তাঁর মনে হতো, কত মানুষ তো মারা যায়, তাঁরই বা বেঁচে থেকে লাভ কী!
মানুষটি হেরে যাননি। বছর দুয়েক টানা প্র্যাকটিসের পর ইলেকট্রোল্যারিঙ্গস যন্ত্র গলার কাছে রেখে মানুষের সঙ্গে দিব্যি কথা বলছেন। মাছ কিনছেন, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছেন, আমেরিকাবাসী দুই ছেলে ও নাতনির সঙ্গে আড্ডা মারছেন। রোগী দেখছেন। তাঁর ধাতব রোবোটিক কন্ঠে এখন ধীরে ধীরে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু, ফের যদি ফিরে আসে ক্যান্সার? ‘আমায় মারতে চাইলে স্ত্রী কান্তার (স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ভদ্রাকান্তা বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে লড়ে ওঁকে আগে হারাতে হবে। ৫০ বছরের পুরনো আর জি কর-এর অঙ্কোলজিস্ট বন্ধু প্রবীরকে (ডাঃ প্রবীর চৌধুরী) হারাতে হবে। তারপর আমার পালা! জানবেন, যে আত্মহত্যা করবে করবে করেও করেনি, সে জীবনকে ভালোবাসে। আমার একটাই থিওরি—মরার আগে মরব না। শনিবার কালিকাপুরের ফ্ল্যাটে বসে ধাতব কন্ঠে একথা শোনালেন পিজি এবং আর জি কর-এর হার্ট ইনস্টিটিউট-এর প্রাক্তন অধিকর্তা অভিজিৎবাবু। রেডিও জকি বিভূতি চক্রবর্তীর পাশাপাশি যাঁর কামব্যাক নিয়ে আস্ত সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন পরিচালক শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটি—কন্ঠ! শিবপ্রসাদ বললেন, ওঁর লড়াই উদাহরণ। তাই সিনেমায়ও ওঁর জীবনের বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখিয়েছি। অভিজিৎবাবুর স্পিচ থেরাপিস্ট সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বললেন, লড়াই কাকে বলে, দেখিয়ে দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। কুর্নিশ ওঁকে।
১৯৬৮-’৬৯ সাল থেকে চিমনির মতো সিগারেট খেতেন। দিনে কমপক্ষে ২০টি। ২০০৬ সাল থেকে গলা ভারী হতে শুরু করে। সেই বছর আইএমএ’র একটি অনুষ্ঠানে হার্টের অসুখ নিয়ে ভাষণ শুরু করলে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আর জি কর-এর তিন বছরের সিনিয়র দাদা বিখ্যাত ইএনটি সার্জেন ডাঃ দুলাল বসু দেখে বলেন, আমার কিন্তু ভালো ঠেকছে না। তুই বায়োপসি কর। রিপোর্টে ধরা পড়ল স্বরযন্ত্রে ক্যান্সার। বন্ধু প্রবীর শহরে ফিরে এসে অন্যান্য রিপোর্ট দেখে বললেন, শুধু স্বরযন্ত্র নয়, ডানদিকের ফুসফুসেও ক্যান্সার (ম্যালিগনেন্ট পালমোনারি নডিউল) হয়েছে।
বন্ধুর উদ্যোগে আমেরিকায় ডানদিকের ফুসফুস থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ বাদ দেওয়া হল (লোবেকটমি)। স্বরযন্ত্রের জন্য ৩৩টি রেডিয়েশন হল। ২০০৭ সালে একটি পথ দুর্ঘটনার পর হঠাৎ বমি আরম্ভ হওয়ায় ধরা পড়ল সেরিব্রাল হেমারেজ—স্ট্রোক। এরপর ধরা পড়ল ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস। তখন তিনি পিজি’র হার্ট ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর। হারেননি তাতেও। ২০১১ সালে দুলালবাবু তাঁকে বললেন, তোর আর একবার চেক-আপ দরকার। চেক-আপে ধরা পড়ল, ক্যান্সারও হারেনি। ফিরে এসেছে। এবার গোটা স্বরযন্ত্রটাই বাদ দিতেই হবে তাঁর। বাকি জীবনের মতো হারিয়ে যাবে কন্ঠ।
বাদ গেল স্বরযন্ত্র। ফের কেমোথেরাপি। এই সময় অভিজিৎবাবু মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। মনের মধ্যে উঁকি দেয় আত্মহত্যার প্রবণতা। ক্যান্সার আক্রান্তদের ক্ষেত্রে যা বলা হয় ‘কিমোরেজ’। অদৃশ্য একজন তাঁকে অন্য কোনও দেশে নিয়ে যেতে চায়, খারাপ স্বপ্ন দেখায়। কানের কাছে বলে, এ জীবন নিয়ে আর লাভ কী! আর তাঁর পরিবার-স্ত্রী-ঘনিষ্ঠরা অন্য প্রান্তে সজোরে বলতে থাকেন, পৃথিবীর চেয়ে সুন্দর কিছু আছে কী!
স্পিচ থেরাপিস্ট সোমনাথবাবুর সাহায্যে শুরু হয় থেরাপি। খাদ্যনালীর মাধ্যমে কথা বলার অভ্যাস, অন্যদিকে ইলেকট্রোল্যারিঙ্গস যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিম স্বরে কথা বলা। কিন্তু, এত বছরের রোগী দেখা? সিদ্ধান্ত নেন, আর রোগী দেখবেন না। স্ত্রীকেও বললেন সবাইকে বলে দিতে। শুনে এক রোগী তাঁকে বললেন, আপনার স্বরযন্ত্র নেই। তাতে হয়েছেটা কী? রোবোট স্বরেই কথা বলুন। হয় আপনি আমাদের দেখবেন, না হলে দল বেঁধে বাড়িতে হাঙ্গামা করব! অগত্যা স্ত্রী স্বামীকে নিয়ে চেম্বারে গেলেন। ধাতব স্বরে কথা শুরু করলেন কার্ডিওলজিস্ট। কিছুক্ষণ পর রোগীরাই দল বেঁধে স্ত্রীকে বললেন, আপনাকে আর চেম্বারে আসতে হবে না বউদি। আমরাই ডাক্তারবাবুর কথা বুঝে নেব।