পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
হাওড়ার বহু প্রসিদ্ধ টাইপ রাইটার তৈরির মেশিন রেমিংটন বন্ধ হয়ে সেখানে বহুতল গড়ে উঠেছে। অন্য কারখানাগুলিও ধুঁকছে। এক সময় জি টি রোডের ধারে ছিল অসংখ্য জুটমিল। তার অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যেগুলি চলছে, সেগুলিও বন্ধ হওয়ার মুখে। শিল্প বলতে এখন হাওড়ায় শুধু নির্মাণশিল্প। বিশ্বকর্মা পুজোয় নির্মাণ শিল্পের মালিকরাই আয়োজনে মেতে থাকেন।
কথা হচ্ছিল বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের কর্মী নির্মলেন্দু ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক সময় বার্ন স্ট্যান্ডার্ডে প্রতিটি বিভাগে আলাদা আলাদা করে পুজো হত। পরে সব বিভাগ মিলে পুজোর আয়োজন করতে শুরু করে। কারখানা তো বটেই, তার আশপাশ এলাকাও আলোয় মুড়ে দেওয়া হত। চন্দননগরের আলোয় ঝলমল করত গোটা শহর। কিন্তু, নয়ের দশকের গোড়া থেকেই ধীরে ধীরে পুজোর জৌলুস কমতে শুরু করে। তখন দুর্গাপুজো শহরে হলেও এত জাঁকজমক ছিল না। একই কথা শোনালেন রেমিংটনে কাজ করা উচ্চপদস্থ অফিসার ভবানীপ্রসাদ রায়। পুজোর দিন সকাল থেকেই সকল কর্মী-পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে কারখানায় হাজির হয়ে যেতেন। পুজোর পর প্রসাদ খাওয়া। দুপুরে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হত। সন্ধ্যায় হত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে যেমন কর্মীদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা অংশ নিত, তেমনই বাইরে থেকে বড় শিল্পীদেরও আনা হত। অন্তত দু’দিন ধরে পুজোর আনন্দে আমরা মেতে থাকতাম। কিন্তু, ধীরে ধীরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই আনন্দ আর নেই।
ব্রিজ অ্যান্ড রুফের কর্মী প্রাণতোষ মজুমদার বলেন, এটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা। এখনও এই সংস্থা লাভজনক অবস্থায় আছে। কিন্তু, সরকার এই সংস্থা বন্ধ করে দিতে চাইছে। এই কারণে এখন আর পুজোয় সেভাবে জৌলুস নেই। কোনও রকমে পুজো হয়। আগের মতো আলো দিয়ে কারখানা সাজানো বা কর্মীদের পরিবারকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া তা আর হয় না। কিছুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে সাঁতরাগাছি রেল প্রেস। তা নিয়েও আন্দোলনে নেমেছে সেখানকার শ্রমিক সংগঠনগুলি। এক সময় এখানেও বিশ্বকর্মা পুজোয় জাঁকজমক ছিল।
শহরের বাসিন্দারাই বলছেন, বড় কিছু কারখানার জমিতে গড়ে উঠেছে বহুতল। আরও কিছু ফাঁকা জমিতে গড়ে উঠছে বড় বড় আবাসন। তাই একমাত্র নির্মাণশিল্পেই কিছুটা হলেও বিশ্বকর্মা পুজোয় জাঁকজমক হয়। কিন্তু, সেখানে কর্মী ও তাঁদের পরিবারের অংশগ্রহণ সেভাবে থাকে না।
হুগলি শিল্পাঞ্চলের ডানকুনি থেকে ভদ্রেশ্বর, শ্রীরামপুর, রিষড়া এবং চুঁচুড়া, তারকেশ্বরের অংশবিশেষে বিশ্বকর্মা পুজোর আয়োজন হয়েছে। সময়ের সঙ্গে জৌলুস হারালেও বিশ্বকর্মা পুজোয় প্রবল হয়েছে রাজনীতি। সদ্য লোকসভা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে শ্রমিক মহল্লার দখল নিতে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে টানোপোড়েনের প্রভাব জড়িয়ে গিয়েছে বিশ্বকর্মা পুজোতেও। তবে বিজেপি এখনও পা জমাতে না পারায় নানান শিল্প-কারখানায় তৃণমূল প্রভাবই বেশি।
যদিও শাসকদলের শ্রমিক শাখা আইএনটিটিইউসি’র জেলা সভাপতি বিদ্যুৎ রাউত বলেন, আমাদের তত্ত্বাবধানে কোনও পুজো হুগলিতে হয় না। সাধারণ শ্রমিকদের পুজো, তারাই করে। এখানে দলাদলির বিষয় নেই। এখানে অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে এটা সত্য, কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছরে কোনও কারখানা বন্ধ হয়নি। বিজেপি’র শ্রমিক শাখা ভারতীয় জনতা মজদুর ট্রেড ইউনিয়ন কাউন্সিলের হুগলি সাংগঠনিক জেলা সভাপতি সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, জেলার অনেকগুলি পুজোই আমাদের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। তবে এবার আমরা রাজনৈতিক কারণেই প্রকাশ্যে থাকছি না। আর জেলার শিল্পাঞ্চল মুখ থুবড়ে পড়ছে রাজ্য সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যে। কোনও শিল্প খোলার জন্যে বা বন্ধ হয়ে যাওয়া রুখতে সরকার পদক্ষেপ করেনি। এরই মধ্যে বাস্তব পরিস্থিতির কথা বলেছেন তৃণমূলের শ্রমিক শাখার কোর কমিটির সদস্য অন্বয় চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, শিল্পের জমিতে এখানে আবাসন গড়ে উঠছে। এই হতশ্রী দশার মধ্যেও পুজো হচ্ছে, এটাই যা।
সেই বাম আমল থেকেই হুগলি শিল্পাঞ্চলে রাহুর দশা শুরু হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতাতে আজও গোন্দলপাড়া জুটমিল বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গলক্ষ্মী কটনের জমিতে আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। এই মুহূর্তে জেলার বড় কারখানাগুলির অধিকাংশই বন্ধ। চালু ১০টি জুটমিলের মধ্যে ৭টি কোনওরকমে টিকে আছে। তিনটি পুরোপুরি বন্ধ। তার মধ্যেও শ্রীরামপুর, রিষড়া, ডানকুনি বিশেষ করে দিল্লি রোড, জি টি রোড আর দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে প্যান্ডেল আর মাইকের কলরব সেই উদ্যোগের চিহ্ন বহন করছে। তাতে জৌলুস তেমন না থাকলেও পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। দেবশিল্পীর আরাধনার দিনে দীর্ঘদিন নিঝুম হয়ে পড়ে থাকা কারখানাগুলি কোনও এক সুদিনের অপেক্ষায় দিন গুনছে।