রিনি মণ্ডল, প্রত্যক্ষদর্শী: দিদা, মাসি আর আমি— তিনজনই গিয়েছিলেন ওখানে। সরু রাস্তা। দিদা মানে কৌশি মণ্ডল আর মাসি সাগরী পাড়ুই। প্রচণ্ড ভিড়। গিজগিজ করছে লোকজন। নিঃশ্বাস ফেলা দায়। পিফা রাঘবপুরে আমাদের বাড়ি থেকে সবাই মিলে যখন বেরলাম, তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। প্রতিবার দিদা আর মাসি হেঁটেই কচুয়া যায়। এবারও সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে বাবার মন্দিরের দিকে রওনা দিলাম। রাত ১১টা নাগাদ বাবার মন্দিরের কাছাকাছি এসে পড়লাম। তারপর শুরু জল দেওয়ার লাইন। লম্বা লাইন। একফালি রাস্তা। পাশে দোকানপাট। গায়ে পাঁচিল। অন্ধকার কালো আকাশ। কিন্তু, অতকিছু ভালো করে দেখার মতো অবস্থা ছিল না আমাদের। চারপাশে হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক। ভাবছিলাম, কেন আমার মতো অত ছোট মেয়েকে নিয়ে ওরা এখানে এসেছে? এত্ত ভিড়, ভালো করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছি না। হঠাৎ দেখি ঠেলাঠেলি শুরু হল। দিদা ভিড় থেকে বাঁচতে পাঁচিলের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে ভিড়ের চোটে সেই পাঁচিলে উঠেও পড়েছিল। হুড়মুড় করে পাঁচিলটাই ভেঙে পড়ল। দিদা বেঁচে গেল। কিন্তু, পড়ল তো পড়ল, তা গিয়ে পড়ল একবারে দিদার হাতের উপর। রক্তারক্তি অবস্থা। একটা আঙুল তো কেটে একটু লেগে রয়েছে হাতের সঙ্গে। সেই অবস্থাতেই প্রাণ বাঁচাতে ছুট লাগাল দিদা। আমি কী করি, সঙ্গে সঙ্গে দে দৌড়। দিদা, মাসির সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে ছুটেছি। চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি, আর্তনাদ। এ ওর গায়ে পড়ে যাচ্ছে। মানুষকে মাড়িয়ে মানুষ চলে যাচ্ছে, গলা ফাটানো চিৎকার চারদিকে। প্রচণ্ড হইচইয়ে আবার সেই চিৎকার ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। মাগো, সেই দৃশ্য যে দেখার নয়।
এখন আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যখনই ও কথা মনে হচ্ছে, কুঁকড়ে যাচ্ছি, শিউরে উঠছি। তবে প্রাণে বেঁচেছি। আমার দিদি দীপিকা মণ্ডলও আলাদাভাবে গেছিল মন্দিরে। কিছু হয়নি। ভগবান বাঁচিয়েছেন। দিদা খুব ভয় পেয়ে যায়। এখন হাসপাতালে ভর্তি। ওর ডান হাতের কড়ে আঙুল যেটা আছে না, তার পাশের আঙুলটা বাদ দিতে হয়েছে, বাবা বলল। আর কিছু হয়নি। এখানে আমার সঙ্গে সবার কথা হয়েছে। এইসব কাণ্ড নিয়ে বাবা-মা কিছুই জানত না। যদি না মাসি ফোন করে ওদের জানিয়ে দিত। ও ঠিক বুদ্ধি করে একটু বিপদ কাটতেই ওদের ফোন করে দিয়েছে। সবার সঙ্গে দেখা হয়ে এখন আগের থেকে অনেকটা ভালো আছি।
তবে কোনও দিন ভুলব না দিদার পিছন পিছন বাঁচার জন্য ওই দৌড়। দিদার আঙুল কেটে গিয়েছে, সেই অবস্থাতে হুড়মুড় করে ছোটা। জীবনে ভুলব না। বাবা-মাকে বলব, আমাকে আর কাছছাড়া করো না তোমরা। আমার ভয় লেগেছে। খুব ভয়।