বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
সেই মুঘল সাম্রাজ্য আজ ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসকেই আবার যদি ফিরে দেখা যেত? এবার সেই আম-দরবারের ইতিহাসকেই আরও একবার ফেরাতে চেষ্টা করছে ঐতিহ্যবাহী সাবর্ণ পরিবার। আগামী ২৩ জুন রবিবার বিকেলে সাবর্ণদের মূল ঠিকানা বড়িশার ‘বড়বাড়ি’তে বসছে ‘মুঘল দরবার’। না, কোনও নাটক বা থিয়েটারের আসর নয়। এখানে নেই কোনও রাজসিংহাসন। নেই রাজমুকুট বা রাজাও। কিন্তু হাজির থাকবেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের ২৭তম বংশধর। সুদূর ওমান থেকে আসছেন তিনি। সেই দরবারে মুখ্য ভূমিকায় তিনিই। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্দরমহলের অকথিত কাহিনী সেদিন আমজনতা শুনবে তাঁরই মুখ থেকে। আরও একবার ফিরে দেখা হবে ভারতীয় ঐতিহ্যের অন্যতম জমকালো রাজকাহিনী।
কোন কোন অজানা কথা উঠে আসবে ওই মুঘল দরবারে? অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পরিষদের সম্পাদক দেবর্ষি রায় চৌধুরীর কথায়, মুঘলদের নিয়ে যে ইতিহাস পড়ানো হয় পাঠ্যবইতে, তাতে আর কতটুকুই বা থাকে। আমরা আরও বেশি করে মুঘলদের সম্পর্কে জানতে চাই। আমরা জানি, রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট ওরঙ্গজেবও যে সতীদাহ প্রথা রদ করেছিলেন, তা ক’জন জানেন? ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ আইনে বিধবা বিবাহ চালু করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তা সবার জানা। কিন্তু সম্রাট আকবর হিন্দু বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন মুঘল যুগে, তা কি অনেকেরই অজানা নয়? ওরঙ্গজেব সম্রাট হলেও, তিনি তাঁর খাওয়দাওয়ার খরচ রাজকোষ থেকে নিতেন না, তাও তো জানেন না অনেকেই। তিনি নিজে নমাজের টুপি বুনতেন ও বিক্রি করতেন। সেই টাকা থেকে যা আয় হত, তাতে যতটুকু খাওয়ার জুটত, তাই-ই খেতেন সম্রাট। মুঘল আমলে রাজবাড়ির মেয়েরা যে অত্যন্ত শিক্ষিত ও বিদূষী ছিলেন, তাও অনেকের অজানা। একটি নিজস্ব লাইব্রেরি তৈরি করেছিলেন নূরজাহান, যেখানে নিয়মিত সাহিত্যচর্চা হত। সেখানে অবাধ যাতায়াত ছিল নাতনি জাহানারার। হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম তো নিজেই হুমায়ুননামা লিখেছেন ও নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দেবর্ষিবাবুর কথায়, আমরা মুঘল দরবারের কথা জানাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজির হয়েছি। সেখানে বহু ইতিহাসবিদ ও সাধারণ মানুষ আমাদের নানা প্রশ্ন করছেন। সেসবের উত্তর খোঁজার কাজ চলছে। সাবর্ণদের মুঘল দরবারে ওমান থেকে হাজির হচ্ছেন মুঘল বংশধর মমতাজ হোসেন চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ী চৌধুরী এবং কন্যা অমৃতা চৌধুরী। বাহাদুর শাহ জাফরের মেজ ছেলে রুকুদ্দিন হোসেনের বংশধর হলেন মমতাজ হোসেন। হরেক প্রশ্নের পাশাপাশি তাঁরা তুলে ধরবেন মুঘলদের সংস্কৃতি, খানাপিনা বা অন্দরমহলের অজানা কাহিনী। অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার কথা অধ্যাপক, স্কলার বা গবেষকদেরও।
সাবর্ণ সংগ্রহশালা সারা বছর খোলা থাকে, যেখানে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারেন সাধারণ মানুষ। এর পাশাপাশি একবার করে আন্তর্জাতিক মেলা বসে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে, যেখানে চমক থাকে নানারকম। এসবের পরেও কেন মুঘলদের রাজ দরবার নিয়ে অভিনব উদ্যোগ? পরিবারের কর্তারা বলছেন, আসলে মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সাবর্ণদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সাবর্ণ পরিবারের ১৯তম পুরুষ পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় হুমায়ুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন যুদ্ধের মূল পরামর্শদাতাও। আপন বন্ধুকে ‘শক্তিখান’ উপাধি দেন সম্রাট হুমায়ুন। পাশাপাশি পান তখনকার হাভেলি শহরের জায়গির, যা এখন হালিশহর নামে পরিচিত। মুঘলদের বন্ধুত্বের খাতিরে এলাকায় ‘পাঁচুশক্তিখান’ বলে পরিচিত হন ওই সাবর্ণ-সন্তান। সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাত ধরে উপঢৌকন হিসেবে হীরের আংটির পাশাপাশি ১৬০৮ সালে আটখানা পরগনা নিষ্কর জায়গির পায় সাবর্ণরা। আজকের হালিশহর থেকে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত এলাকায় শুরু হয় নতুন জনজীবন। আধুনিক কলকাতার গোড়াপত্তন হয় তখনই। সুদূর দিল্লির সিংহাসন থেকে এভাবেই গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে যায় বঙ্গদেশ। সাবর্ণ পরিবারের কথায়, দিল্লির ওই সুন্নি মুসলিম রাজ পরিবারের সঙ্গে বাংলার ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের ৪৮০ বছরের পুরনো সম্পর্ককেই আরও একবার উদযাপন করতে চাইছেন তাঁরা। এই আধুনিক আম দরবারে সিংহাসন নয়, সোফায় বসবেন ‘রাজা’। প্রজা নয়, রাজসভা নয়, সভাঘরে হাজির হবেন ইতিহাসের সুলুকসন্ধানীরা। শুরু হবে আধুনিক মুঘল দরবার।