কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
মঙ্গলবার এই ধর্মঘটের জেরে রাজ্যের দূর প্রান্ত থেকে আসা শয়ে শয়ে দিন আনি দিন খাই মানুষ কাজকর্ম ফেলে, কোলে সন্তান, সঙ্গে মা, স্ত্রী বা আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ছন্নছাড়ার মতো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরেছেন। কিন্তু, একজনও চিকিৎসা পেয়েছেন কি না সন্দেহ! এর আগেও ডাক্তার ধর্মঘট দেখেছে বাংলা। কিন্তু, মঙ্গলবার আউটডোর, ইমার্জেন্সি সহ সমস্ত ধরনের পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাই চিকিৎসা পাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায় সাধারণ মানুষের। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে ঢুকতে যাতে না পারেন বা কোনক্রমে ঢুকে পড়লে, যাতে সাধারণ রোগীরা বেরতে না পারেন, এদিন তারও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন ধর্মঘটী জুনিয়র ডাক্তাররা।
তখন দুপুর দেড়টা। এনআরএসের ইমার্জেন্সি গেটের সামনে কথা হচ্ছিল মৌলালির লালমতিদেবীর সঙ্গে। সামনেই তখন গেট আটকে বিক্ষোভ চালাচ্ছেন প্রায় একশো জুনিয়র ডাক্তার। গেটের অন্য প্রান্ত থেকে রোগী ও বাড়ির লোকজন অনবরত তাঁদের অনুরোধ করে যাচ্ছেন, একবার গেটটা খুলুন দয়া করে। রোগী যে বাঁচবে না। উত্তর আসছে, না বাঁচলে আমরা কী করব? বাঁচাতে যাব? ওই বাঁচাতে গিয়েই তো আমাদের এক বন্ধু তোমাদের মার খেয়ে এখন কোমায়। ঢের হয়েছে, আর নয়। আর আমরা তোমাদের বাঁচাতে আসব না! অন্য হাসপাতালে যাও।
সে সময় লালমতি বলছিলেন, কীভাবে চার মাসের দুধের শিশু অসুস্থ আরোহীকে ডাক্তার দেখাতে ইমার্জেন্সির দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। ভিড়ের ঠেলায় ইমার্জেন্সিতে ঢুকতেই পারলেন না। আউটডোরও বন্ধ। প্রচণ্ড গরমে সব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এখন হতাশ হয়ে অপেক্ষায় আছেন, কখন বাচ্চাকে নিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন। অসুস্থ বাচ্চাটি তখন প্রচণ্ড গরমে মায়ের কোলে শুয়ে পড়েছে।
তখন দুপুর দুটো। এনআরএস-এর আউটডোর। অন্য সময় কয়েক হাজার রোগী ও বাড়ির লোকজনের দমবন্ধ করা ভিড় থাকে। আর মঙ্গলবার, আউটডোরের বাইরে যখন ওসি থেকে ডিসি আর পুলিসে পুলিসে ছয়লাপ, বাইরে যখন সামিয়ানা টাঙিয়ে বিক্ষোভে শামিল কয়েকশো জুনিয়র ডাক্তার, হাসপাতালে জল মাপতে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন নয়ত মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলছেন কয়েকজন মেজো ও বড় ডাক্তার— তখন আউটডোর বাড়ির দোতলা ও তিনতলা খাঁ খাঁ করছে। সবেতেই তালা। নেমে আসার সময় দেখা গেল, হন্তদন্ত হয়ে একটি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছেন তাঁর মা। যখন জানলেন সব বন্ধ, হতাশায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, আমার নাম রুনা মজুমদার। ১৩ বছরের মেয়ে তৃষা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। এদিন ছিল ওর চেক আপের দিন। বালি থেকে পড়িমড়ি করে আসছি। যদি দেরি হয়ে যায়। এখানে এসে দেখি চারদিকে এইসব চলছে। ভয়ও লাগছে। আবার মেয়ের জন্য চিন্তাও হচ্ছে। বলতে পারেন, কবে উঠবে ধর্মঘট? মেয়েটাকে যে দেখাতেই হবে।
মিনিট পাঁচেক কাটতে না কাটতে দেখা হল আরও এক রোগীর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে। কোলে মেয়ে। তার মধ্যেই যতটা দ্রুত সম্ভব আউটডোরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায়, চেষ্টা করছেন। নাম বাবুলাল কাপাসিয়া। মেয়ে ঈশা কাপাসিয়া। বাড়ি করিমপুরে। বাচ্চাটি ক’দিন আগে ইলেকট্রিক শক খায়। ঘুমিয়ে পড়া মেয়ের ছোট্ট হাতের মুঠোটা খুলে কড়ে আঙুলটা দেখাচ্ছিলেন, দেখুন, কেমন বেঁকে রয়েছে আঙুলটা। আজ ডাক্তারদের দেখাতে আসার কথা ছিল। এখন দেখছি ধর্মঘট। তাহলে মেয়েকে আজ আর দেখাতে পারব না?
আউটডোর থেকে কিছুটা দূরে ঝিলপারে তখন কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। একদিকে ঢিল ছোঁড়া দূরে জুনিয়র ডাক্তারদের সম্মিলিত প্রতিবাদ আকাশ-বাতাসে গজরাচ্ছে, অন্যদিকে ঝিলপারে ক্লান্ত হয়ে অসুস্থ বাড়ির লোকজনকে নিয়ে মেঝেয় শুয়ে পড়েছেন গ্রামবাংলার বহু জন খাটা, মুদির দোকান চালানো নয়ত চাষের কাজ করা মানুষ। তাঁরা কেউ এদিন আউটডোরে ডাক্তার দেখাতে পারেননি। বাড়িও ফিরবেন না। তাতেও দমেননি। গলার সুর, যা হবে দেখা যাবে। আজ, বুধবার ডাক্তার দেখিয়ে তবে ফিরব। তাঁদের যে বড়লোকদের হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তা নেই।